কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া কেনিয়ার ক্রিকেট এবং স্টিভ টিকলো
বিশ্ব ক্রিকেটে এক সময়ের পরিচিত নাম কেনিয়া। স্টিভ টিকলো, মরিস উদুম্বে, থমাস উদোয়ো, কলিনস ওবোয়া, পিটার অনগন্ডো ও উদিয়োম্বোরা ছিলেন কেনিয়ার ক্রিকেটের প্রাণ। নব্বই দশক ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেও যাদের ক্রিকেটে মুগ্ধতা ছিল। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলা দলটি যেখানে টেস্ট মর্যাদা লাভের সম্ভাবনা ছিলো, সেখানে উল্টো সফলতার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে না পারায় হারিয়ে যেতে বসেছে ক্রিকেট আকাশ থেকে।
আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকাই ছিলো ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ। জিম্বাবুয়ের (পূর্বের নাম রোডেশিয়া) পাশাপাশি ১৯৮১ সালে আইসিসির সহযোগী সদস্য হওয়ার মাধ্যমে স্বীকৃত ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করে কেনিয়া। নিয়মিত খেলার ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে কেনিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফির (বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব) ফাইনাল খেলে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে কেনিয়া। একই বাছাই পর্বে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করলেও ফাইনাল খেলতে পারেনি।
বাছাই পর্বের ফাইনাল খেলে ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করা কেনিয়া বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে নিজেদের অভিষেক ওয়ানডে ম্যাচ খেলে। ভারতের সাথে ৭ উইকেটের পরাজয়ে শুরু হলেও একই বিশ্বকাপে দুইবারের বিশ্বকাপজয়ী শক্তিশালী উইন্ডিজকে ৭৩ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে বাজিমাত করে কেনিয়া। কেনিয়ার গড়া ১৬৬ রানের জবাবে মরিস উদুম্বে ও রজব আলীর বোলিং তোপে মাত্র ৯৩ রানে অলআউট হয়েছিল রিচি রিচার্ডসনের নেতৃত্বাধীন তারকা সমৃদ্ধ ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
১৯৯৬ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত নিয়মিত ৫টি বিশ্বকাপ খেলা কেনিয়া ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ের সাথে স্বাগতিক দেশ হিসেবে খেলে। এই বিশ্বকাপে দলটি সেমিফাইনালে খেলে তাক লাগিয়ে দেয়। সেমিফাইনালে ভারতের সাথে হেরে বিদায় নিলেও কেনিয়ার সামর্থ্যরে প্রমাণ দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। যদিও গ্রæপ পর্বে নিউজিল্যান্ডের ওয়াকওভারের কারনে কেনিয়া জয় পেয়ে যাওয়া বেশ ভ‚মিকা রেখেছিল তাদের সেমিফাইনালে উঠতে। এছাড়া বাংলাদেশ ও শ্রীলংকাকে হারানোও দারুণ অর্জন ছিলো তাদের।
২০০৭ আর ২০১১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেললেও ২০১৪ সালের টি২০ ও ২০১৫ বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারায় ২০১৪ সালে ওয়ানডে ও টি২০ খেলার যোগ্যতা হারায় দলটি যাহা ক্রিকেট বিশ্বে হৈচৈ ফেলে দেওয়া দলটির জন্য খুবই লজ্জার।
বাংলাদেশ ৩০০ রানের মাইকফলক ছুয়েছে ২০০৬ সালে এই কেনিয়ার বিরুদ্ধে। আর কেনিয়া ১৯৯৭ সালেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৩৪৭ রান করেছিল। সে ম্যাচে সর্বোচ্চ ১৪৪ রান করেন কেনেডি ওটিয়েনো।
দেশের হয়ে ১৩৫ ম্যাচে ১১১ বেস্টে সর্বোচ্চ ৩৩৬৯ রান করেন স্টিভ টিকলো। আর বোলিং এ টমাস ওডোয়ো ১৩৬ ম্যাচে ৪ বেস্টে সর্বোচ্চ ১৪৫ উইকেট লাভ করেন।
অলরাউন্ডার হিসেবে স্টিভ টিকলো ৩৩৬৯ রানের পাশাাপশি ৪ উইকেট বেস্টে সর্বমোট ৯৩ উইকেট লাভ করেন এবং টমাস ওডোয়ো ১১১ বেস্টে ২৪২০ রানের পাশাপাশি ১৪৫ উইকেট লাভ করেন। এছাড়াও দেশের হয়ে কোলিনস ওবোয়ো, কেনেডি ওটিয়েনো, পিটার অনগনডো, রবিন্দ শাহ, নেহেমিয়া ওডিয়েম্বো সহ অনেকেই ব্যাটে বলে ভালো খেলেছেন।
টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিরুদ্ধে জয়ের রেকর্ড হিসেবে ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে ২টি, জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ৫টি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলংকার বিরুদ্ধে ১টি করে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৬টি ম্যাচে জয় লাভ করেন।
প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপ ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালে পূর্ব আফ্রিকার অংশ হিসেবে বিশ্বকাপে অংশ নিলেও আলাদা দেশ হিসেবে ১৯৯৬ সালে প্রথম বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেন।
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে ২০০০, ২০০২, ২০০৪ সালে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছিলেন।
২০০৭ সালের প্রথম টি২০ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করলেও তার পর থেকে সর্বশেষ ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ পর্যন্ত আর টি২০ বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি দলটি।
অর্থনৈতিক ভাবে ততটা সমৃদ্ধশালী না হওয়ায় এবং নিম্নমুখী পারফরম্যান্স এর কারনে দলটি ২০০৭ সালের পর কখনোই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি।
যে দেশটি ৫টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের সাথে জয়ের রেকর্ড আছে, ৩টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের সাথে একাধিক ম্যাচ জেতার রেকর্ড আছে সে দেশটি বর্তমানে বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার টূর্নামেন্টের ৮/৯ নাম্বার পজিশনে থাকতে হচ্ছে!
ক্রিকেটের বিশ্বায়নের যুগে কেনিয়া ক্রিকেটের এমন পরিণতি ক্রিকেটের জন্য ভালো দিক নয়।
যে দেশে ১৯৯৫-২০০০ এর মধ্যে স্টিভ টিকলো ও টমাস ওডোয়োর মতো শক্তিশালী ক্রিকেটার এর আবির্ভাব হতে পারে, সে দেশে বর্তমান সময়ে কোন ভালো ক্রিকেটার নেই, এটা মানা অসম্ভব। ক্রিকেট কেনিয়ার অধপতনের কারন একটাই হতে পারে, তা হলো অর্থনৈতিক ভাবে ততটা সমৃদ্ধশালী না হওয়া।
ক্রিকেট জিম্বাবুয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজও অর্থনৈতিক ভাবে ততটা মজবুত নয়, যার কারনে প্রায়শ খেলোয়াররা খেলার হুমকি দেয়, কিন্তু তা আবার কিছুদিনের মধ্যেই মিটে যায়। কিন্তু কেনিয়া মনে হয় এ সমস্যা কখনোই সমাধান করতে পারেনি এবং ঘরোয়া ক্রিকেটকে কখনোই শক্তিশালী করতে পারেনি। যার দরুন আজকের এই পরিণতি।
আইসিসির সহযোগী দেশ হয়ে ৭টি টেস্ট খেলুড়ে দেশকে লজ্জা দিয়ে যে দেশ এক যুগ আগে তথা ২০০৩ সালেই ৩য় পজিশনে থেকে বিশ্বকাপ শেষ করতে পারে, সে দেশ ২০১৪-১৫ বিশ্বকাপ খেলতে না পারা সহ ওয়ানডে/টি২০ মর্যাদা হারানো নিঃসন্দেহে আইসিসির জন্য লজ্জাজনক বিষয়।
আইসিসি ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা হিসেবে এ দায় কখনোই এড়াতে পারে না। ক্রিকেটের বিশ্বায়নের যুগে যেখানে অপরিচিত দেশগুলোও ক্রিকেটে ভিড়তে পারছে এবং আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশও ক্রিকেট শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, সেখানে কেনিয়ার এমন অধপতন মেনে নেওয়া অসম্ভব।
২০০৩ এ সেমিফাইনাল খেলা সহ ৩য় পজিশনে থেকে বিশ্বকাপ শেষ করার গৌরব অর্জনের প্রতিদান হিসেবে এবং অভিভাবক হিসেবে আইসিসির উচিত কেনিয়ার ক্রিকেটের উন্নয়নে পাশে দাড়ানো।
ব্যর্থতার চূড়ান্তে নিমজ্জিত হওয়া দলটির ক্রিকেট ভবিষ্যত অন্ধারাচ্ছন্ন। আইসিসি ও প্রভাবশালী বোর্ডদের সহায়তা ছাড়া আলোকিত হওয়ার কোন রাস্তাই তাদের সামনে নেই।
কেনিয়ার ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা স্টিভ টিকলো। ব্যাটে বলে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করে নিজ সময়ে বিশ্ব ক্রিকেটের আলোচিত মুখ ছিলেন টিকলো। অবসর পরবর্তী সময়ে কেনিয়ার হেড কোচ হলেও দলটির এখন ওয়ানডে মর্যাদাও নেই। টি২০ খেলছেন শুধুমাত্র।
স্টিভ টিকলো ঢাকার ক্রিকেটেও পরিচিত মুখ। ২০০০ সালে মোহামেডানের হয়ে ঢাকা লীগের এক মৌসুমেই হাজার রান করার গৌরব আছে টিকলোর। অবশ্য তখন ঢাকা লীগের ম্যাচগুলোর লিষ্ট এ মর্যাদা ছিলো না।
২০০৬/০৭ সালের দিকে বাংলাদেশ দল যখন কেনিয়ার সাথে সিরিজ খেলতো এবং কেনিয়াকে হোয়াইটওয়াশ করতো, তখন অনেক মজা পেতাম এই ভেবে যে, এই কেনিয়ার সাথেই একসময় হেরেছে বাংলাদেশ, এখন তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। সেই থেকেই পিছিয়ে যাওয়া কেনিয়া ২০১১ সালের বিশ্বকাপ খেলার পর আর টিকে থাকতে পারেনি ওয়ানডে ক্রিকেটে। বিশ্ব ক্রিকেট যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ক্রিকেট কেনিয়ার হারিয়ে যাওয়া দুঃখজনক বিষয় ছাড়া কিছু নয়।
ক্রিকেট কেনিয়ার সবচেয়ে বড় তারকা স্টিভ টিকলো ও সমসাময়িক ক্রিকেটাররা বিদায় নেয়ার সাথে সাথে যেনো ক্রিকেট কেনিয়ার সুদিনও বিদায় নিয়েছে।
আজ স্টিভ টিকলোর ৫০তম জন্মদিন। জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
কেনিয়ার ক্রিকেট আবার জেগে উঠবে কিনা জানি না, কেননা আইসিসিরও উদ্যোগ নেই পুরনো দলগুলোকে আলাদা মূল্যায়ণ করে তোলে আনার। অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল কেনিয়ার ক্রিকেট লাইফসাপোর্টে টিকে থাকলেও পুরনো উদ্যমী ও সফলতামন্ডিত কেনিয়াকে আবার কখনো দেখা যাবে কিনা সে প্রশ্ন তোলা থাক সময়ের কাছে।