নিরাপদ খাদ্যই কি আগামীর চ্যালেঞ্জ?

ভোক্তা হলো বাজারের নেতৃস্থানীয় উপাদান।সমসাময়িক বিশ্বে ভোক্তাদের খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় প্রতিটি দেশ চ্যালেঞ্জ এর সম্মুখীন।বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।বিশেষ করে গত দশকে খাদ্যে ভেজালের মাত্রা এতই বেড়েছে যে,ভোক্তাদের বাজারের নিদিষ্ট খাদ্যসামগ্রী নির্বাচন করাই চ্যালেঞ্জিং মনে হয়।নিত্য প্রয়োজনীয় মাছ,মাংস,দুধ,সবজি,ফলমূল,তেল জাতীয় পণ্যে ইচ্ছামতো প্রয়োগ করা হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ।প্রতি বছর পবিত্র রমজান মাসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এর মাত্রা মাথাচড়া দিয়ে উঠে।এক্ষেত্রে সরকারও খাদ্যে ভেজাল মোকাবেলায় রযেছে সোচ্চার।তাই সাধারণ জনগণের নিরপত্তায় প্রণয়ন করা হয়েছে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯,নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এবং ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫।এতো আইন প্রণয়ণই প্রমাণ করে সরকার ক্রেতাদের নিরাপত্তায় বদ্ধ পরিকর।অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করা হচ্ছে মোবাইল কোর্ট।করা হচ্ছে জেল-জরিমানা।বিশ্ব খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার মতে,প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ৪ কোটি লোক ভেজাল খাদ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে সরাসরি আক্রান্ত হচ্ছে।

মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য অন্যতম।বাঁচার জন্য চাই খাদ্য।কিন্তু সেই খাদ্য আকর্ষণীয় করতে যখন প্রয়োগ করা হচ্ছে অবৈধ পন্থা তখন তা পরিণত হচ্ছে ভেজাল খাদ্যে।ভেজাল হিসেবে প্রয়োগ করা হয় রং,বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান,ফরমালিন, বিভিন্ন ক্ষতিকারক প্রিজারভেটিভ,অপর্যাপ্ত মান নিয়ন্ত্রণ,অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে উৎপাদন ও সংরক্ষণ ইত্যাদি।নিত্য ব্যবহার্য খাদ্যসামগ্রী সংরক্ষণের নামে যখন এসব প্রাণঘাতী রাসায়ণিক পদার্থ মিশ্রণ করা হয় তখন সে খাদ্য হয়ে যায় বিষ।এ ভেজাল খাদ্য নামক বিষ খেয়ে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন শারীরিক রোগে। যার প্রভাব পড়ছে মানুষের সামগ্রিক জীবন প্রণালী ও গড় আয়ুতে।এশিয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা উপর পরিচালিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়,বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩১.৯শতাংশ মাঝারি থেকে নিম্নমানের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে।সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি খুবই ভীতকর এবং নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তার মারাত্মক অন্তরায়।

প্রশ্ন দাঁড়ায় বর্তমান বিশ্বে মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার পরও কেন বিভিন্ন মহামারী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে? এর অর্ন্তমূল কারণ হিসেবে অবশ্যই অনিরাপদ খাদ্যকে দাঁড় করানো যায়।

পবিত্র রমজান মাস প্রায় আসন্ন।এই রমজানকে কেন্দ্র করে দেশে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী আমদানিকৃত অনেক ইফতারি পণ্যতে মিশ্রিত করে বিভিন্ন রং এবং ফরমালিন।অসাধু ব্যবসায়ীরা উৎপাদনকৃত ও আমদানিকৃত এসব পণ্য মাসব্যাপী সংরক্ষণে অবৈধ এবং অনিরাপদ উপায়ে সংরক্ষণের চেষ্টা করে।রমজানে ইফতারিতে যার যার সাধ্যমতো প্রায় সব ধরণের খাদ্যই রাখার চেষ্টা করা হয।এতে বাজারে খাদ্যেসামগ্রীর প্রচুর চাহিদা দেখা দেয়।মানুষ ফলমূল এবং মিষ্টি জাতীয় খাবার ইফতারে আহার করে।মিষ্টি জাতীয় খাবারের মধ্যে প্রায়ইশ দেখা যায় জিলাপিতে ভেজাল সোডা প্রয়োগ করে সুস্বাধু করা হয়।কলা,আম,লিচু জাতীয় ফলে ফরমালিন দিয়ে অপরিপক্ব ফলকে পরিপক্ব এবং পাকা দেখিয়ে বিক্রি করার প্রবণতা লক্ষ্য করা হয় নির্বিচারে।মাছ-মাংসে অনিরাপদ প্রিজারভেটিভ প্রয়োগ করা হয়।এসব খাদ্য গ্রহনের ফলে মানুষের স্বল্পমেয়াদী লক্ষণ হিসেবে পেটে পীড়া,অস্বস্থি,পেট ব্যথা দেখা দেয় নিত্যনৈমিত্তিক।আর এসব ভেজাল খাবারের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মারাত্মক ও অদৃশ্য।কালক্রমে মানুষের অজান্তেই শরীরে অনেক জটিল রোগ দেখা দেয়।মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হলেও এসব ভেজাল খাবার গ্রহণ করে শারীরিক জটিলতায় ভোগে থাকে।বিষয়টির গভীর অনুধাবনে বলা যায়,খাদ্যে ভেজাল একটি জাতীয় অভিশাপ।এটি জাতীকে পঙ্গু করার নামান্তর।দেশের জনশক্তির কর্মক্ষমতা হ্রাসে ভেজাল খাদ্যের রয়েছে নীরব ভূমিকা। কতিপয় অসাধু লোভী ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ভেজাল নিয়ে খেলায়মত্ত রয়েছে।শাকসবজি,ফলমূলে অনেক দিন সংরক্ষণে প্রয়োগ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক পদার্থ। মানব জীবনে নেমে আসছে অদৃশ্য মাহামারী।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় হিমশিম খেতে হচ্ছে।অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা পাওয়ার আশায় খাদ্যে ভেজাল দিয়ে খাদ্যসামগ্রীর চাহিদা বাড়ানো একটি প্রচলিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভোক্তারা এসব খাবারে অভ্যস্ত হয়ে আক্রান্ত হচ্ছে কিডনী,লিভার ও ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে।

নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তায় ও খাদ্যের ভেজাল প্রতিরোধে আর সময় অপচয় নয়।জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্যে ভেজাল দেয়া অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এখনই সোচ্চার হতে হবে।দেশের কর্মক্ষম জনশক্তিকে পঙ্গু করার হাত থেকে পরিত্রাণ দিতে সবাইকে এক সাথে কাজ করতে হবে। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট ও ভেজাল বিরোধী অভিযানকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে কঠিন শাস্তির বিধান অব্যাহত রাখতে হবে।খাদ্যে ভেজাল দেয়া অসাধু ব্যবসায়ীদের মোকাবেলায় সোচ্চার হয়ে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে সরকার।তবে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে,আইন করে মানুষের সহজাত আচরণ যতটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় তার চেয়ে বরং নৈতিক বোধ জাগ্রত করে সমস্যার দ্রুত সমাধান পাওয়া যায়।
জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে গোপনে বাজার মনিটরিং টিম গঠন করে এর কার্যকর সমাধান আসবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।সরকার প্রতিনিয়ত তার প্রশাসনের মাধ্যেমে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বর্তমানে সারা দেশে ভোক্তার অধিকার এবং খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে চোখে পড়ার মতো কার্যকর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।ব্যবসায়ীদের নিরাপদ খাদ্যে যোগানের নিশ্চয়তা ও ভোজাল খাদ্য গ্রহণের ক্ষতিকর প্রভাব অনুধাবনে নেয়ার নৈতিক বিষয়টি বোধগম্য করে তুলতে হবে।স্থানীয়ভাবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনকারী এবং বিক্রয়কারীদের বাৎসরকি শুদ্বাচার পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।এতে করে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চয়তা ধরে রাখায় তাদের মধ্যে এক ধরণের ইতিবাচক প্রতিযোগিতা তৈরী হবে।
খাদ্যে ভেজালে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এর ২৫সি ধারায় অপরাধের শাস্তি রয়েছে মৃতুদন্ড বা ১৪ বছরের কারাদন্ড।প্রশ্ন হচ্ছে এতো কঠোর এবং কঠিন আইন থাকার পরও কেন দেশে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না? তাই খাদ্যে ভোজালের শাস্তির বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করতে হবে এবং এর বাস্তাবিক প্রয়োগও ঘটাতে হবে।

বাজারে খাদ্য সামগ্রী কেনা বেচায় ক্রেতা-বিক্রেতার দায়িত্বশীল সম্পর্ক তৈরিতে কাজ করতে হবে।ফলমূল এবং নিত্যপণ্য সামগ্রী সংরক্ষণে বাজার ভিত্তিক স্বাস্থ্যকর প্রিজারভেটিম ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরী।জাতীয় ও কোন ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে যাতে মানহীন খাদ্য সামগ্রী বেশিদিন বিক্রির উদ্দেশ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ফরমালিন দেয়া না হয় সে বিষয়ে কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে।নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ভোক্তা ও বিক্রেতা এবং সুশীল জনগণের মধ্যে হতে বাজার ভিত্তিক কার্যকর মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে।যারা সময়ে সময়ে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে জাতীয় পর্যায়ে ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধে কার্যকর ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে।পণ্য উৎপাদনকারী ও বিক্রেতাদের শুদ্বাচারের উপর সময়ে সময়ে বাজার মিটিং করে নৈতিক শিক্ষা উন্নয়ন ঘটানোর উপর জোর দিতে হবে।খাদ্যে ভেজাল সম্পর্কে ধর্মীয় শিক্ষা ও ধর্মীয় শাস্তির বিষয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তুলে ধরতে হবে।

সর্বশেষ এক জরীপের কথা উল্লেখ করে বলতে চাই,দক্ষিণ এশিয়া ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ অসুস্থ হচ্ছে যার অর্ধেকই প্রায় শিশু।এতে প্রমাণ হয়,খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে আমাদের দেশেও ভবিষ্যত জনশক্তি বিশেষ করে কোমলমতি শিশুদের জীবন হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। মোদ্দাকথা অনিরাপদ খাদ্য বা ভেজাল খাদ্যকে জাতীয় অভিশাপ হিসেবে তুলে ধরে স্থানীয় এবং জাতীয়ভাবে মোকাবেলা করতে হবে।বাঁচাতে হবে আগামীর বাংলাদেশকে।বাঁচাতে হবে কর্মক্ষম জনশক্তিকে।গড়ে তুলতে হবে আগামীর শিশুদের জন্য নিরাপদ খাদ্য,নিরাপদ প্রজন্ম।
তাই সকলেই সুকান্তের কন্ঠে কন্ঠে মিলিয়ে প্রতিজ্ঞা করা উচিত –
এ বিশ্বকে শিশুর বাস যোগ্য ক’রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।”

লেখক: কলামিস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Created with Visual Composer