বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ

0
2

১৭ই মার্চ।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০২তম জন্মবার্ষিকী।১৯২০ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী,বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও লাল-সবুজ পতাকার রুপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।এই মহান পুরুষের জন্ম না হলে,জন্ম হতো না বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ও স্বার্বভৌম ভূখন্ডের।আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নন,নন শুধু একজন রাষ্ট্রনায়ক বরং শেখ মুজিবুর রহমান আজ বাংলার ঘরে ঘরে একটি অনুভূতির নাম।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-ই ১৯৬৯ সালে এই ভূ-খন্ডটির নামকরণ করেন বাংলাদেশ।ধর্ম,বর্ণ,দলমত নির্বিশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অবিস্মরণীয় নাম।তরুণ প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আদর্শের এক মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু।এই মহান সাহসী রাষ্ট্রনায়কের জন্ম না হলে,বাঙ্গালী জাতি পেত না স্বাধীনতার স্বাদ।ঠিক তেমনি স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো বাংলাদেশ।ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ব্যাক্তিগতভাবে অত্যন্ত নম্য,ভদ্র,সাহসী,বাগ্মী ও তেজদীপ্ত।একজন আদর্শ নেতার যেসব গুনাবলি থাকা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধুর মধ্যে তার সবটুকুই বিদ্যমান ছিল।যার দরুণ তিনি বাংলার সীমানা পেরিয়ে বিশ^ নেতাদের মধ্যে নিজেকে স্থান করে নিয়েছিলেন।তাই তার রাজনৈতিক ক্যারিশমা ও ব্যাক্তিগত মুগ্ধতায় কিউবার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন,আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।ব্যাক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়”।

শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলার অবিসংবাদিত এক সাহসী নেতা।১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ পরবর্তী তিনি ছাত্রনেতা থেকে ক্রমেই জাতীয় নেতায় পরিণত হন।১৯৪৮ সালে তিনি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন।পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ ভাষার দাবিতে জীবনের দ্বিতীয় বার কারাভোগ করেন।অবশ্য জীবনের প্রথম কারা ভোগ করেন গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেনীতে অধ্যয়নকালে ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগদানের দরুন।ছাত্র জীবন থেকে তিনি সাধারণ মানুষের ন্যায্য আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে সাধারণ কর্মচারীদের অধিকার আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হন।অবশ্য দীর্ঘ ৬১ বছর পর ২০১০ সালে এই বহিষ্কারাদেশ বিশ^বিদ্যালয় থেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে জাতির পিতাকে সম্মানীত স্থানে আসীন করা হয়।মোট কথায় শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল সম্পূর্ণরুপে জেল,জুলুম ও সাধারণ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ১লা মার্চ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের বিষয় সম্বলিত ৬ দফা দাবির বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন এবং বাঙ্গালী জাতির মুক্তির সনদ ৬দফা উত্থাপন করলে পশ্চিম পাকিস্তান সামরিক শাসক আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে আসামী করে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করে এবং গ্রেফতার করা হয়।পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী তখন ঠিকই বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে, শেখ মুজিবকে জেল-মামলা দিয়ে দমাতে না পারলে পূর্ব পাকিস্তানের আলাদা স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা ঠেকিয়ে রাখা খুব কঠিন হবে।পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে গণঅভ্যত্থানে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।১৯৭০ সালে সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে তিনি বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পরিগনিত হন।কিন্তু তাকে সরকার গঠনের সুযোগ দেয়া হয়নি।সরকার গঠন প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও ভুট্টো পূর্বপাকিস্তান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা ব্যর্থ হয়।ফলে ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরীহ বাঙ্গালী জাতির ওপর বর্বর গণহত্যা চালায়।এবং জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।স্বাধীনতা ঘোষণার কিছুক্ষণ পরেই পাকিস্তানি সেনারা তাকে পাকিস্তানি লায়ালপুর কারাগারে নিয়ে যায় এবং দশ মাস কারাগারে বন্দী করে রাখে।এর আগে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে(বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ এর ভাষণে বজ্রকন্ঠে জানান দেন,
এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম;
এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম; জয় বাংলা…….

তার এ ঐতিহাসিক ঘোষণা বাংলাদেশের আপাময় জনসাধরণকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শক্তি ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর বাঙ্গালি জাতি যুদ্ধে ঝঁপিয়ে পড়ে।অবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২লক্ষ মা-বোনের সম্ভমের বিনিময়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়।দীর্ঘ ১০ মাস মাস পাকিস্তানে কারাভোগের পর ১৯৭২ সালে ১০ জানিুয়ারি মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও নয়াদিল্লী হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে ফিরে আসেন।এরপর স্বাধীন বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন।কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে বিশ^াসঘাতকদের নির্মম বুলেটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিপারে নিহত হন।বাংলাদেশে এই দিনটি একটি কালো অধ্যায়।বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে ঘাতকরা বাংলাদেশকে হত্যা করেছিল।বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে থামানোর পাঁয়তারা ছিল এ হত্যাকান্ড।এই দেশকে ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যে পৃথিবীর ইতিহাসের এই ন্যাক্বারজনক হত্যাকান্ড ঘটানো হয়।কিন্তু ঘাতক ও অপশক্তির ইচ্ছা আদৌ বাংলার মাটিতে পূরণ হয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের আপাময় জনসাধারণের কর্তৃক স্বীকৃত ও পরীক্ষিত এক মহান রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব। বিশেষ করে তার রাজনৈতিক সাহসীকতা ও বাগ্মীতা তরুণ প্রজন্মের জন্য আর্শীবাদ স্বরুপ।তার রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শন সর্বকালের সব দেশের জন্য শিক্ষার পাথেয়।তিনি প্রথম বাংলাদেশকে বহি:বিশে^ উপস্থাপন করেন।১৯৭৪ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাংলাদেশকে বিশে^র দরবারে হাজির করেন।এবং বিশ^ নেতাদের নজর কাড়েন।শেখ মুজিবুর রহমান সারা বিশে^ বাগ্মী নেতা হিসেবে পরিচিত। এজন্যই ২০০৪ বিবিসি বাংলা কর্তৃক পরিচালিত জরিপে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে,বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল রাজনীতি আর জেলময়। তার ’অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে আমরা জানতে পারি, বঙ্গবন্ধু স্কুল জীবন থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত মোট ৪৬৮২দিন কারাভোগ করেছেন।২৩ বছরের পাকিস্তানের শাসনামলে তিনি জেলে গিয়েছেন ১৮ বার।একজন রাজনৈতিক ব্যাক্তির জীবন কতোটা নির্মম ও দূরহ হতে পারে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন দর্শন না করলে বুঝা কঠিন।জাতির পিতার রাজনৈতিক জীবন অবলোকন করলে দেখা যায়,তিনি জীবনের অধিকাংশ সময়ই দিয়েছেন দেশের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য।এমনকি রাজনৈতিক জেল-জুলুমের জন্য নিজ পরিবারকে খুব একটি বেশি সময় দিতে পারেননি।একজন রাষ্ট্রনায়ক মনের দিক দিয়ে কতোটা উন্নত হলে দেশের জন্য অসাধ্য ত্যাগ করতে পারেন তা বঙ্গবন্ধুর জীবন পাঠ করলে সহজেই অনুনেময়।

বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণের প্রতিটি লাইন আজও স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষের কাছে একটি আবেগ-ও অনুভূতির নাম।বঙ্গবন্ধুর বাগ্মী ভাষণ শুনলে আজও হ্নদয় প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।তিনি পাকিস্তানি শাসকদের মোকাবেলার উদ্দেশ্য বলেছিলেন,”আর যদি একটা গুলি চলে,আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়,তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো,প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।”

বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ মুক্তিযুদ্ধাদের ব্যাপকভাবে সাহস যুগিয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঠিক আগে তার ১৮ মিনিট ভাষণে যে শব্দগুলো চয়ন করে গিয়েছেন প্রতিটি শব্দ ছিল বাঙ্গালি জাতিস্বত্ত্বা সংরক্ষণের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।যে প্রতিজ্ঞা বাংলাদেশের মুক্তিকামীদের স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখাতে সহায়তা করেছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব।রাজনৈতিক দূরদর্শিতা,কূটনৈতিক ব্যাক্তিত্ব,বাগ্মীতা ও সাহসীকতার প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন প্রভাবশালী।তিনি ছিলেন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ২৩ বছরের বঞ্চনার শৃঙ্খল ভাঙ্গার কারিগর।বঙ্গবন্ধু জীবনের ১৪টি বছর কারাগারে বন্দি ছিলেন।কিন্তু তিনি বাংলাদেশের স্বাধীকার প্রশ্ন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে ছিলেন আপোষহীন।তার সুদূরপ্রসারী বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১সালে স্বাধীনতা অর্জন ও তৎপরবর্তী ভূমিকা ও কৃতিত্ব অপরিসীম।বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিনিমার্ণ ও সংরক্ষণ এবং বহি:বিশে^ বাংলাদেশের উপস্থিতি জানান দেয়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্বাভরে স্মরণ করি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক এই মহান ব্যাক্তিত্বকে। তার আদর্শ ও শিক্ষা হউক আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে পাথেয়।পরিশেষে বলতে চাই,বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও বাংলাদেশের জন্ম একই সূথোয় গাঁথা।বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ।

লেখক: কলামিস্ট।

[email protected]

আপনার মন্তব্য