যৌতুক, দেনমোহর ও তালাক প্রসঙ্গে
যৌতুক একটি সামাজিক অভিশাপের নাম, ধর্মীয়ভাবে বিবাহের সময় যৌতুক ধার্য্য করা নিষিদ্ধ কাজ। রাষ্ট্রীয় আইনেও যৌতুককে নিরুৎসাহিত করে যৌতুক গ্রহণকারী ও ইচ্ছাকৃতভাবে যৌতুক প্রদানকারীর বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। অপরদিকে দেনমোহর নারীর ধর্মীয় অধিকার, পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিধান মতে বিবাহের সময় মোহরানা ধার্য্য করা আবশ্যিক বিধান, তবে তার নির্দিষ্ট কোন পরিমাণ ধার্য্য না করা হলেও ১০ দিরহামের নিচে দেনমোহর ধার্য্য করতে নিষেধ করা হয়েছে। বাংলাদেশে যৌতুক গ্রহণ, বরের সাধ্যাতিত দেনমোহর ধার্য্য ও পরবর্তীতে বৈবাহিক সম্পর্কে ফাটল ধরার প্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যে তালাক হয়ে গেলে দেনমোহর পরিশোধ বিষয়ে অজ্ঞতা ও অস্পষ্টতা বিদ্যমান, যার ফলে জটিল আকার ধারণ করে সমাধানের ক্ষেত্রে।
যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ এ যৌতুকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষের নিকট বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসাবে বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ অব্যাহত রাখিবার শর্তে, বিবাহের পণ বাবদ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, দাবিকৃত বা বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষেকে প্রদত্ত বা প্রদানের জন্য সম্মত কোনো অর্থ-সামগ্রী বা অন্য কোনো সম্পদই যৌতুক, তবে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ্) প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তিগণের ক্ষেত্রে দেনমোহর বা মোহরানা অথবা বিবাহের সময় বিবাহের পক্ষগণের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা শুভাকাঙ্ক্ষী কর্তৃক বিবাহের কোনো পক্ষকে প্রদত্ত উপহার-সামগ্রী যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত হইবে না। বিবাহের সময় দুই পক্ষের আত্মীয় স্বজন কর্তৃক স্বপ্রনোদিত (দাবীকৃত নয়) হয়ে বর বা কনেকে যে উপহার সামগ্রী প্রদান করেন তা যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত নয়।
যৌতুকের সাথে দেনমোহরের কোন সম্পর্ক নেই, যৌতুক সমাজপতিদের দ্বারা তৈরীকৃত একটি অভিশপ্ত নিয়ম, এর সাথে বিবাহ কিংবা দেনমোহরের কোন সম্পর্ক নেই। যৌতুক ছাড়া বিবাহ হয়, কিন্তু দেনমোহর নির্ধারণ ছাড়া বিবাহ সম্পন্ন হয় না। দেনমোহর বিবাহের দিনই পরিশোধযোগ্য, স্বামী যদি বিবাহের দিন দেনমোহরের সম্পূর্ণ অংশ পরিশোধ করতে না পারেন, তাহলে স্বর্ণালংকার কিংবা নগদ অর্থ দ্বারা আংশিক (উশুল) মোহরানা পরিশোধ করেন, অবশিষ্ট মোহরানা পরবর্তীতে পরিশোধের শর্ত থাকে নিকাহনামায় (কাবিননামায়)। পরবর্তীতে পরিশোধ করা আবশ্যক, যতটা আবশ্যক বকেয়া টাকা পরিশোধ করা। স্বামী যদি দেনমোহরের টাকা পরিশোধের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করে, তাহলেও দেনমোহর মওকুফ হয় না, স্বামীর সম্পদ থেকে অবশ্যই দেনমোহর আদায় করবে তার উত্তরাধিকার, কিন্তু আমাদের সমাজে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী দেনমোহর পাবে দূরের কথা, উল্টো নানা বঞ্ছনার শিকার হন নারী।
আমাদের সমাজের অনেকেই বলেন, বিবাহে যৌতুক নেইনি, তাই দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে না কিংভা কেউ বলে, ছেলে যৌতুক গ্রহণ করেছে, তাই অবশ্যই দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে। এই ভ্রান্ত ধারণা আমাদের সমাজে এমনভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক হয়ে যায়, তখন বিবাহের সময় ধার্য্যকৃত মোহরানার মধ্যে নগদে পরিশোধিত (স্বর্ণালংকার কিংবা নগদ অর্থ) উশুল ব্যতীত অবশিষ্ট দেনমোহর পরিশোধ করতে হয় না, মনে করেন অনেকে। এছাড়াও স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক দিলে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হয় না, মনে করেন যা সত্যি নয়। বিবাহ সম্পন্ন হলেই নারীর দেনমোহর হক হয়ে যায়, এই হক সাথে সাথে আদায় না করে বকেয়া রাখলেও তা থেকে নারীর স্বেচ্ছা দাবী পরিত্যাগ ব্যতীত স্বামী কর্তৃক অবশ্যই আদায় করতে হবে।
একটি সহজ উদাহরণই বুঝার জন্য যথেষ্ট যে, ইসলামের বিধান মতে কোন বিয়েতে যদি ৫০ হাজার টাকা দেনমোহর ধার্য্য করা হয় এবং স্বামী বিয়ের দিন কিংবা দ্রæতই সেটা পরিশোধ করে দেন, তারপর যদি উভয়ের মধ্যে তালাক হয়ে যায়, তখন নারীর আর দেনমোহর দাবীর সুযোগ থাকে না কিংবা পুরুষ বলতে পারবে না যে, আমার টাকা আমাকে ফেরত দাও। কিন্তু আমাদের দেশে দেনমোহরের টাকা বকেয়া থাকে বলেই পরবর্তীতে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেলে দেনমোহর পরিশোধ করতে গড়িমসি করে স্বামী। আবার বরের সামর্থ্যরে অতিরিক্ত দেনমোহর ধার্য্য করার কারনেও পরবর্তীতে তালাক হয়ে গেলে দেনমোহর পরিশোধ করতে চায় না বর/বর পক্ষ, যা ঠিক নয় এবং এটি স্পষ্ট অন্যের হক মেরে খাওয়ার সামিল।
যৌতুক, দেনমোহর ও তালাক প্রসঙ্গে আমাদের ভুল ধারণাগুলো পরিহার করে বিবাহের মতো পবিত্র বন্ধনে যৌতুকের লেনদেন বন্ধ করতে হবে। বরের সামর্থ্যরে বাহিরে মোহরানা ধার্য্য বন্ধ করতে হবে। সামর্থ্য অনুযায়ী দেনমোহর ধার্য্য করলে তা বিবাহের সময়েই পরিশোধের সংস্কৃতি চালু হবে, যার মাধ্যমে নারীদের মধ্যে তাদের ধর্মীয় সম্মান অর্জন করে শান্তিপূর্ণ দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করার স্পৃহা তৈরী হবে। কোন কারনে তালাক হয়ে গেলেও দেনমোহরের টাকা পরিশোধের বিষয়ে জটিলতা পরিহার করা সম্ভব হবে।
শিক্ষার্থী
ডিপ্লোমা ইন জার্নালিজম
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম)
কাটাবন, ঢাকা।