৫৫ বছর বয়সে ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেবেন বেলায়েত শেখ

কথায় আছে না মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়ো! ৫৫ বছর বয়সী প্রবীণ বেলায়েত শেখের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ সে কথার বাস্তব উদাহরণ হয়ে থাকবে। স্বীয় ৩ সন্তান একে একে ব্যর্থ হয়েছেন। বেলায়েত শেখ তাই নিজেই যুদ্ধ জয়ের মিশনে নেমেছেন।

৫৫ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছেন বেলায়েত শেখ। আগামী জুন মাসে এ পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে। গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পশ্চিমখণ্ড এলাকার মৃত হাসেন আলী শেখ ও জয়গন বিবির ছেলে বেলায়েত শেখ। চলতি বছর তিনি এইচএসসি (ভোকেশনাল) পাস করেন ঢাকা মহানগর কারিগরি কলেজ থেকে। এর আগে ২০১৯ সালে বাসাবোর দারুল ইসলাম আলিম মাদ্রাসা থেকে দাখিল (ভোকেশনাল) পাস করেন।

তার স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনার। সেই লক্ষ্যে সাইফুরস ভার্সিটি কোচিংয়ের মাওনা শাখায় ক্লাস করছেন তিনি। পেশায় তিনি একজন সাংবাদিক। জাতীয় দৈনিক করতোয়ার শ্রীপুর প্রতিনিধি তিনি। এছাড়া জেটিভি অনলাইনের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করছেন।

জানা গেছে, বেলায়েত শেখের জন্ম ১৯৬৮ সালে। ছোটবেলা থেকেই খুব কাছ থেকে অভাব দেখেছেন। এর মধ্যেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। অভাবের তাড়নায় ১৯৮৩ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি তার।

বেলায়েত বলেন, ১৯৮৩ সালে আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। তখন বাবার অসুস্থতা এবং অভাবের তাড়নায় পরীক্ষা দিতে পারিনি। ফরম ফিলাপের টাকা দিয়ে বাবার চিকিৎসা করাতে হয়েছিল। এরপর ১৯৮৮ সালে পরীক্ষা দিতে চাইলাম। সে বছর শুরু হলো বন্যা। ১৯৯০ সালেও পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি। সে সময় মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মায়ের কথা ভেবে বিয়ে করি। বাবার তখনও অভাব ছিল। সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছিল। ২৫-২৬ বছর একাধারে আমিই সংসার চালিয়েছি। এসএসসি দিতে না পারায় মেকানিক্যাল কোর্স করেছিলাম। মোটর গাড়ির ওয়ার্কশপ ছিল। ওইসব করেই সংসার চালাতে হয়েছে। ভাই-বোনদের পড়াশোনা করানোর দায়িত্ব ছিল আমার ঘাড়ে। কিন্তু তারপরও তাদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত না করতে পারার আক্ষেপ রয়ে গেছে। এই সময়ে আর লেখাপড়ারও সুযোগ পাইনি।

বেলায়েত শেখের তিন সন্তান। ১৯৯৪ সালে তার প্রথম ছেলের জন্ম। বিরতি দিয়ে সে এখন গাজীপুরের একটি কলেজে অনার্সে পড়ছে। মাওনা চৌরাস্তায় তাকে স্যানেটারির দোকান করে দিয়েছেন। সম্প্রতি তাকে বিয়েও করিয়েছেন। একমাত্র মেয়ের জন্ম ১৯৯৯ সালে। ইচ্ছে ছিল তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন। সেজন্য রাজধানীর নামকরা কলেজে ভর্তিও করিয়েছেন। কিন্তু মেয়ে সেখানে পড়াশোনা না করেই গ্রামে চলে যায়। সেখানে এইচএসসি শেষে একটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়। সে অনার্স সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়েছে। এরপর তার বিয়ে দেন। তার ছোট ছেলের জন্ম ২০০৫ সালে। সে এ বছর বেলায়েত শেখের সঙ্গে এইচএসসি পাস করেছে।

বেলায়েত শেখ বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল সন্তানরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। অনেক আশা ছিল তাদের নিয়ে। কিন্তু তিন সন্তানের কেউই তা পূরণ করতে পারেনি। সেই ক্ষোভ থেকে ২০১৯ সালে এসএসসি আর ২০২১ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিই শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আশায়।

তিনি বলেন, ভর্তি পরীক্ষার জন্য শুরুর দিকে প্রস্তুতি নিইনি। তবে এইচএসসি পরীক্ষার ফল ভালো হওয়ায় বাড়তি ভালো লাগা কাজ করল। ভাবলাম, আমি চাইলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারব। আমার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরাও আমাকে পড়ালেখার সুযোগ দিচ্ছে। এরপর শ্রীপুরের মাওনায় রাজধানী থেকে পরিচালিত একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছি। আমার তো বাবা নেই, মারও বয়স হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে অভিভাবক হিসেবে কাউকে যাওয়া লাগতে পারে। এসব চিন্তা করে বড় ছেলেকে অভিভাবক দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, বয়স চল্লিশ পার হলে পড়া আর মাথায় ঢোকে না। আমি পড়তে গেলে পড়া সহজে মুখস্থ হয় না, কষ্ট হয়। এজন্য পড়াগুলো আমি বারবার লিখি। লিখতে লিখতে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করি। বাকিটা আল্লাহর দান আর মানুষের দোয়া।

বেলায়েত বলেন, সময় তো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আমার চুল পেকে গেছে। সেজন্য চুলে কালি দিই। বয়স বেশি হলেও নিজেকে মনের দিক থেকে তরুণ ভাবতে পছন্দ করি। ৫৫ বছর বয়সে আগামী ১১ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেব। আল্লাহর কাছে সাহায্য ও সকলের কাছে দোয়া চাই।

সাইফুরস মাওনা শাখার শিক্ষক হীরক রাজ বলেন, বেলায়েত শেখের সাথে আমার পরিচয় সাইফুরস মাওনা শাখাতে ক্লাস নিতে গিয়ে। প্রথমে ক্লাসে ঢুকে তাকে দেখে একটু অবাক হই, মনে মনে ভাবি হয়ত কোনো মেয়ের অভিভাবক। কিন্তু তিনি যখন আমার লেকচার মনোযোগ দিয়ে খাতায় তুলছেন আর মাঝে মাঝে আমাকে প্রশ্ন করছেন তখন উনাকে জিজ্ঞেস করি। তারপর বুঝলাম উনিও এবার পরীক্ষা দেবেন। এটা দেখে খুবই অবাক হয়েছি। আবার ভালো লাগাও কাজ করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Created with Visual Composer