জমিরের স্বপ্ন

তোমারে কইলাম, শহরে যাও, একটা চাকুরী খোঁজ। বাড়ীতে পইরা থাইকা কিছুই করতে পারবা না।

<নারে জোহরা, আমারে দিয়া চাকুরী-বাকরি অইবো না। তার উপর লেহাপড়া তেমন করি নাই। ছোট বেলায় বাপ মইরা গেছে, মায়ে কষ্ট কইরা বড় করছে। গায়ে যা কাম পাই তাই করি, কোনমতে দিন কাটাইতে পারলেই অইবো, আমার বড়লোক হওয়ার স্বাদ নাই, তুই আমারে জোর করিস না। স্ত্রী জোহরাকে চাকুরীতে অনীহার কথা এভাবেই জানায় জমির। আমরা না হয় চারডা ডালভাত খাইয়া চইলা যামু, আমাদের যদি সন্তানাদি অয়, তাদের জন্য তো ভাবতে অইব নাকি। আমি গায়ের মানুষ, যখন যা কাম পাই করি, বর্ষাকালে নিজের জালে মাছ ধরি। গায়ের মাডির গ্রাণ আমারে পাগল কইরা রাখে সবসময়। সবাইর জীবনে সব অয়না জোহরা, তুই চিন্তা করিস না, আমি জীবনে কিছু করতে না পারলেও আল্লায় যদি আমারে পোলা মাইয়া দেয়, তাগোরে আমি আমার মতো অশিক্ষিত, কামলা বানামু না। পড়ালেহা করামু, তারপর তাগোর যা মন চায় তারা করবো। এহন জমিতে পানি উডা শুরু অইছে, অনেক মাছ পামু এহন থাইক, দেখবি অনেক মাছ ধরমু, নিজেরা খাইয়া, বাজারে বেচমু। তুইতো জানস এই মাছ ধরাডা আমি ভালা পারি। স্বামীর সাথে কথায় পারা যাবে না, বাড়ির বাহিরে গিয়ে কিছু করাতে রাজী করানো যাবে না, তা ভালো ভাবেই বুঝতে পারে জোহরা, তাই আর কথা বাড়ায় না। আমার বাপে তো তোমারে কামলা যাইনাই বিয়া দিছে, কি আর করার। তোমার যা মন চায় করো। জমির মনে মনে ভাবে, বউ তো আমার ভালা চায়। আমি এডা বুঝি, তয় কি করাম। বাপ দাদার বাড়ী, গাঁও ছাইড়া অন্যখানে গিয়া কোন কাজ-কাম করাম, তা মন চায় না আমার। পড়ালেহা করি নাই, কোন কামও শিহি নাই যে, শহরে গিয়া চাকুরী করমু। আমি যা করতে পারি, তা যেনো ঠিকঠাক করতে পারি, এইডা করতে পারলেই আমি খুশি।

এই কয়দিনের বৃষ্টির সাথে সাথে জোয়ারের পানিতে খালগুলো ভরে জমিতে পানি উঠছে। এই সময়টায় মাছ ধরতে বেশ পারদর্শী জমির। একদিকে আন্তা পেতে রাখে, তারপর জমির পানিতে উঠা সরপুটি, বোয়াল সহ নানান প্রজাতির দেশীয় মাছ ধরে পলো, কনুই জাল ও চলের মাধ্যমে। গভীর রাতে একা মাছ ধরতে ভালো লাগে জমিরের। বর্ষাকালকে জমিরের কাছে প্রিয় সময় মনে হয়। মাছ ধরা ছাড়াও বর্ষার পানিতে গোসল করা, সাতরানো এবং বিয়ের পর গত বছর প্রথমবারে মতো বউকে নিয়ে নৌকা করে ঘুরতে যাওয়া, ভালো লাগার তালিকায় নতুন যুক্ত হয়। সকাল থেকে অনবরত বৃষ্টি হয়েছে বিকাল পর্যন্ত। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগ মুহুর্তে আকাশের লালচে বর্ণে দুপুরের মতো আলোকিত হয়ে যায় সন্ধ্যাবেলাও। গত বছর কেনা কনুই জালের ছোট ছোট ছিদ্রগুলো ঠিক করে জমির। পলো ও চল ঠিক করে রাখে। রাতের খাবার খেয়েই মাছ ধরতে বের হবে জমির। বউকে যেভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছে যে, এবার প্রচুর মাছ ধরবে, সে কথা যেনো রাখতে পারে, চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসে জমির। রাতের বেলায় খাওয়ার পর মা ও বউয়ের কাছে দোয়া যায় জমির। তোমরা দোয়া কইরো। আমি গেলাম। সাবধানে যাইস বাপ, বলে জমিরের মা হালিমা বেগম।

জমির জোহরার দিকে তাকায়, জোহরা কিছু বলে না। বের হয়ে আসে জমির।
দিনভর বৃষ্টি হইছে, জমিতে পানি আধো গোলা, আধো পরিস্কার। টর্চ মেরে দেখে মাছ দেখা যায় কিনা। একটা স্বরপুটি দেখতে পেয়ে পলো দিয়ে সেটাকে বন্ধী করে জমির। জমির এই রাতে একটা বোয়াল, তিনটা সরপুটি, চারটা কারফো মাছ শিকার করে। রাত আটটায় বের হওয়ার পর সাড়ে এগারোটার দিকে নতুন পানিতে পায়ে অতিরিক্ত চুলকানির কারনে আরো কিছুক্ষণ মাছ শিকারের ইচ্ছা থাকলেও ঘরে ফিরে আসে জমির।
জমির বাড়ীতে দেখে জোহরা ও হালিমা বেগম গল্প করছে। তোমরা এহনো ঘুমাও নাই।
তুমি মাছ ধরতা গেছো, আমরা কেমনে ঘুমাই। বলে জোহরা।
জমির মাছের ঢুলা জোহরার হাতে দিয়ে বলে, দেখো কতডি মাছ পাইছি। একা কষ্ট অইয়া যায়। পা চুলকানির কারনে আইয়া পরছি তাড়াতাড়ি।
মাছ দেখে খুশি হয় জোহরা ও হালিমা বেগম। নিজেরা খাওয়ার জন্য রেখেও সকালে বাজারে ভালো দামে বিক্রি করা যাবে।
পরদিন সকালে মাছ বিক্রি করে বাড়ীতে এসে খাবার খেয়ে দিনের বেলাতেও মাছ শিকারে বের হয়। দিনের বেলায় জমিরের মতো অনেকেই মাছ ধরতে বের হয়, বেশি মানুষের আনাগুণার কারনে তেমন মাছ পাওয়া যায় না। সকলেই মাছ শিকার করায় একক ভাবে কেউ বেশি পায় না। রাতের বেলায় জমিরের মতো মাছ ধরার মতো কেউ নাই, তাই রাতেই উত্তম সময় মনে করে জমির। খালের পানির ¯্রােতের সাথে বড় বড় মাছ চলাচল করে। তাই আজ গতকালের মতো জমিতে নয়, খালে মাছ শিকারের পরিকল্পনা করে জমির। বাঁশের খুঁটিতে কনুই জাল দিয়ে মাছ শিকারের ফাঁদ তৈরী করে জমি। ¯্রােতের সাথে মাছ যখন সামনের দিকে যেতে চায়, তখন খালের তলা পর্যন্ত পেতে রাখা জালে মাছের ধাক্কা লাগার পরই লাফ দিলে পাতা ফাঁদে আটকা পরে মাছ। একা একা সবকিছু করতে কষ্ট হলেও জমির এই কষ্টকে উপভোগ করে। এই সময়ে তার যে এটাই কাজ। এই কাজটা ঠিকমতো করতেই হবে। আজ রাত দুইটা পর্যন্ত মাছ শিকার করে জমির। ইচ্ছে হচ্ছিল সারারাত থাকবে, কিন্তু চোখের ঘুমের পাশাপাশি বাড়ীতে চিন্তা করবে ভেবে জাল তুলে ফেলে। আজ প্রচুর মাছ আটকা পরেছে। সব দেশী মাছ। ঘরের খাবারের জন্য রেখেও তিন থেকে চার হাজার টাকা বিক্রি করা যাবে ভেবে খুশি হয় জমির। বাড়ীতে ফেরার জোহরাকে সজাগ দেখতে পায় জমির।
মা কি ঘুমাই গেছে?
তয় কি করবো, ঘুমাইতে চায় না, আম্মার শরীডায় জ্বর জ্বর ভাব, তাই ঘুমাই যাইতে কইছি।
কও কি, আম্মার জ্বর উঠছে কহন। আমি একটু দেইখা আই।
যাইও না, এহন ডাক দিয়া তোইলা ঘুম ভাঙ্গানোর দরকার নাই। ঘরে অসুধ ছিলো, খাওয়াই দিছি। সহালে যদি জ্বর থাহে ডাক্তরের কাছে লইয়া যাইও।
জোহরা আজকের মাছ দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়। এত মাছ একসাথে দেখে নাই কখনো সে।
দেখ জোহরা, কত মাছ পাইছি আজ। আরো বেশি পাইতাম, এখলা কষ্ট অইয়া যায়। আর ভালাও লাগে না, চুপচাপ বইসা থাকতে হয় দেইখা।
তুমি কইলে তোমার লগে আমিও যামু।
জোহরার কথা শুনে হাসে জমির। না, তোরে মাছ ধরতে নিমুনা। বাড়ীর বউ মাছ ধরতে যাইবো কেন। আমি একলা যা পারি, ধরমু।
বর্ষার পানি বাড়ীর সমান হয়ে যায় দ্রæতই। মাছ ধরার পদ্ধতি পরিবর্তন করে জমির। নিজের নৌকা থাকায় সহজ হয় অনেক। পুরো বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরে জমির। জোহরা জমিরের মাছ ধরার নেশা দেখে অবাক হয়। বর্ষার মৌসুম শেষেও খাল থেকে মাছ ধরে জমির। এক মৌসুমে অনেক টাকা আয় হয়েছে জমিরের।
জমিরের বউ হঠাৎ করেই খুশির খবর দেয়। বাবা হবে জমির। এই খবর শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় জমির। বউকে কোলে তোলে ফেলে খুশিতে। বিকালেই বাজারে যায়, জোহরার জন্য শাড়ী আনে। খুশি হয় জোহরা। হালিমা বেগমও অনেক খুশি হয়। ঘরে নতুন অতিথি আসছে, এই খুশিতে বাড়ীর সকলকে মিষ্টি এনে খাওয়ায় জমির। অনাগত সন্তানের জন্য মসজিদে মিলাদ পড়ায়।
বর্ষার মৌসুম শেষ। ধান কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছে কৃষকেরা। জমিরের নতুন কাজ ধান কাটা। এভাবেই বছর জুড়ে গ্রামীণ সব কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে জমির। এইসব কাজকর্ম পরিশ্রম হলেও উপভোগ করে জমির। নিজে পরিশ্রমের কাজ করলেও অনাগত সন্তানকে লেখাপড়া শেখাবে জমির। ছোট বেলায় বাবাকে হারানো জমির পড়ালেখা করার সুযোগ না পেলেও সন্তানকে লেখাপড়া করাতে কোন কার্পণ্য করবে না।
-সমাপ্ত-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Created with Visual Composer