ঢাকায় ডায়রিয়া পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতিঃ পথেই মৃত্যু ২৫ জনের

 

  • গড়ে প্রতি মিনিটে একজন রোগী ভর্তি
  • পাশে হাসপাতাল রেখেও রোগীরা ছুটছে আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে
  • পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহের পরামর্শ

মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) হাসপাতালে ঠাঁই নেই। বর্তমানে গড়ে প্রতি মিনিটে একজন করে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী এ হাসপাতালে আসছেন। অসংখ্য রোগীর ভিড় সামাল দিতে হাসপাতালটির চিকিৎসক ও নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ডায়রিয়ার সুচিকিৎসার জন্য স্বনামধন্য রাজধানীর এ হাসপাতালে সম্প্রতি একদিনে সর্বোচ্চ প্রায় ১৪০০ রোগী ভর্তির রেকর্ড হয়েছে। এর আগে ২০০৭ সালে ১ হাজার রোগী ভর্তির রেকর্ড ছিল। চলতি বছরের মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরু থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে।

এ হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দৈনিক গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ জন ছিল। কিন্তু এপ্রিল মাসে দৈনিক রোগীর সংখ্যা ১২০০ থেকে ১৪০০ ছুঁই ছুঁই করছে। গত এক মাসে প্রধানত রাজধানীর পাঁচটি এলাকা- যাত্রাবাড়ী, দক্ষিণখান, গেন্ডারিয়া, মোহাম্মদপুর এবং টঙ্গী থেকে আসা রোগীর সংখ্যা সর্বাধিক। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশই ত্রিশোর্ধ্ব থেকে চল্লিশ বছর বয়সী নারী-পুরুষ।

তারা জানান, গত এক মাসের ব্যবধানে আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের রেজিস্টারে ২৯ জনের মৃত্যু লিপিবদ্ধ হয়। তাদের মধ্যে ২৫ জনের মৃত্যুই বাসা থেকে হাসপাতালে আনার পথে হয়। হাসপাতালে আনার পর তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়। ভর্তি হওয়া চারজনের মৃত্যু হয়। পানিবাহিত ডায়রিয়া রোগটি কী কী কারণে হয় সে সম্পর্কে সরকারিভাবে প্রচার প্রচারণার পাশাপাশি আক্রান্ত এলাকাগুলোতে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
আইসিডিডিআর,বির সিনিয়র ম্যানেজার (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন) এ কে এম তারিফুল ইসলাম খান জাগো নিউজকে জানান, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে আজ (১০ এপ্রিল) দুপুর ২টা পর্যন্ত প্রায় ৫২ হাজার ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়। তার মধ্যে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৩৯ হাজার ৩৭২ জন এবং ১ থেকে ১০ এপ্রিল দুপুর ২টা পর্যন্ত ১২ হাজার ৬১১ জন রোগী ভর্তি হয়। দিনক্ষণ হিসেবে (১ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল) ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা যথাক্রমে ১ হাজার ২৭৪ জন, ১ হাজার ২৭৪ জন, ১ হাজার ১৭১ জন, ১ হাজার ৩৮৩ জন, ১ হাজার ৩৭৯ জন, ১ হাজার ৩৭০ জন, ১ হাজার ৩৮২ জন, ১ হাজার ৩৭৫ জন, ১ হাজার ২৯৬ জন এবং ৭০৭ জন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, পানিবাহিত এ রোগের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে জনসচেতনতা জরুরি। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কার্যকর প্রচার প্রচারণা ও এলাকা বিশেষে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, রেডিও, টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হয়। কিন্তু দেখা গেছে আক্রান্ত রোগীদের অনেকেই এ তিনটি মাধ্যমের কোনোটিই সেভাবে দেখেন না। ওয়াসার পানি ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত হওয়ায় সে পানি খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদের জন্য পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা প্রয়োজন। বর্তমানে রাজধানীতে মাত্র পাঁচটি এলাকায় ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। এসব এলাকায় বিনামূল্যে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করলে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর চাপ কমে যাবে বলে ওই কর্মকর্তা অভিমত ব্যক্ত করেন।

আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালের প্রধান ডা.বাহারুল আলম বলেন, মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দৈনিক গড়ে রোগীর সংখ্যা ৫০০ জনের কম ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।

তিনি বলেন, ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে তার দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিন্তু সম্প্রতি দেখা গেছে দূর-দূরান্ত থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের আশপাশের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য না নিয়ে আইসিডিডিআর,বিতে নিয়ে আসা হয়। বিলম্বের কারণে তাদের অনেকের মৃত্যু হয়। গত এক মাসের ব্যবধানে ২৫ জন রোগী মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। আক্রান্ত রোগীর বাড়ির আশপাশে চিকিৎসা করলে হয়তো রোগীর প্রাণ রক্ষা পেতো। এ ধরনের ভুল করা মোটেই উচিত নয়।

তিনি বলেন, ডায়রিয়া থেকে রক্ষা পেতে বিশুদ্ধ পানি পানের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে পানি ফুটিয়ে খাওয়া, ফুটিয়ে খাওয়ার সুযোগ না থাকলে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বা ফিটকারী ব্যবহার, খাওয়ার আগে ও পরে হাত ভালো করে ধোয়া, বাইরে রাস্তাঘাটে বা খোলা স্থানে, যেখানে ধুলাবালি পড়ে সেসব খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দেন।

বর্তমান ডায়রিয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে রাজধানীসহ সারাদেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ কিছুটা বেড়েছে এ কথা সত্য। কিন্তু প্রতি বছরই এমনটা হয়। তবে আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি বলে তিনি স্বীকার করেন।

তিনি বলেন, ডায়রিয়া রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রচার প্রচারণা (ইলেট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায়) চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি রাজধানীসহ সারাদেশে জেলা উপজেলা পর্যায়ে মাইকিং করে বিশুদ্ধকরণের জন্য পাঁচ মিনিট পানি ফুটিয়ে গরম করে খেতে বলা হচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটও দেওয়া হচ্ছে।

রাজধানীর যেসব স্থান থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী বেশি আসছে সেসব এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোর বাইরে সিটি করপোরেশন এলাকায় স্বাস্থ্য সেবা সিটি করপোরেশন অর্থাৎ স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন থেকে চাহিদা দিলে তারা পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। সোর্সঃ জাগোনিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Created with Visual Composer