দুই দু’টি মহাযুদ্ধ এবং মার্কিনীদের অজেয় থাকার নেপথ্য কারণগুলো

দুই দুইটি মহাযুদ্ধে আমেরিকা ছিল প্রায় অনাক্রান্ত। যুদ্ধে তারাও জড়িত ছিল কিন্তু তাদের নিজ ভূখণ্ডে আক্রমণের ছোঁয়া লাগেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপান যে পার্ল হারবারে হামলা চালিয়েছিল তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ২০০০ কিলোমিটার দূরে প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত। এই আক্রমণের প্রতিফল ছিল খুবই মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়, যা এখনো বিদ্যমান। এর পেছনে যেসব নিয়ামক কাজ করেছে তার মধ্যে একটি হল তার ভৌগোলিক অবস্থান ও বিশালতা।দুইটি মহাসাগরের (প্রশান্ত ও আটলান্টিক) মাঝে অবস্থিত প্রায় ৯৯ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গড়ে উঠা এই দেশটির রয়েছে ৫০ টি স্টেট।ইউরোপ বা আফ্রিকায় আমেরিকা হলে হত পঞ্চাশটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতার পর থেকে গত আড়াইশ বছর ধরে বিভক্তিকে এড়িয়ে ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে আজকের অবস্থানে এসেছে দেশটি।এর মধ্যে ছয়শত বছরের অটোমান সাম্রাজ্যের সূর্য ডুবেছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন দেখেছে বিশ্ব।মূলত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অভিবাসীদের বহুজাতিক আর বহু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ আমেরিকার শক্তি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। অন্যান্য অঞ্চলের জন্য যা বিভক্তি আর খুনোখুনির কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তাই ঐক্যের প্রতিক।বিশ্বের সবচেয়ে সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের দেশ আমেরিকা। স্থলভূমির আয়তন আর জনসংখ্যায় তারা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ।যদি কখনও পৃথিবীতে মার্কিন আধিপত্য কমে অন্য কোন দেশ নেতৃত্বের আসনে আসে তবে তা হবে রাশিয়া, চীন,ভারতের মত বড় কোন দেশ।

একটা সময় ভাবতাম আমেরিকা কিভাবে বিশ্ব শাসন করে?ভৌগোলিক ভাবে তো তারা মানচিত্রের একেবারে পশ্চিম-উত্তর কোণে।তখন আমার ভূগোলের জ্ঞান সমতল বিশ্বেই বিদ্যমান ছিল।কিন্তু আমি যদি সত্যিকারের একটা ভূগোলের দিকে তাকাই, তাহলে রাশিয়া আর আমেরিকা যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র তা বুঝতে বেশিক্ষণ লাগবে না।আবার প্রশান্ত মহাসাগরের দুই পাড়ের দেশ জাপান ও আমেরিকাও আয়াতাকার ম্যাপে যত দূরে দেখায় আদতে তত দূরে নয়।তাই মহাযুদ্ধে আমেরিকা খুব দূরের রাষ্ট্র বলে সুবিধা পেয়েছিল সেই কথা ঠিক নয়।যুদ্ধ করতে যেমন অস্ত্র লাগে তেমনি লাগে বুদ্ধি ও তথ্য।আমার মনে হয় সবকিছুর চেয়ে তথ্যই যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই যে বর্তমান বিশ্বে মার্কিনিদের একাধিপত্য তার অন্যতম কারণ তথ্যের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ।

মোটামুটি ২০০৪ সাল থেকে আমার পত্রিকার সাথে যোগাযোগ। ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা জেনেছি তাতে দেখছি পত্র-পত্রিকা বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মোটাদাগে রাজনীতি আর কূটনীতির আন্তর্জাতিক সংবাদ বলতে এশিয়া, ইউরোপ আর আমেরিকা। পুরো দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকার কানাডা,মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর আফ্রিকা মাঝেমধ্যে খবরের প্রথম পাতায় ঠাই পায়।ক্রিকেটের কারণে আমাদের দেশের অনেক লোক অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের দুইটা দেশের নাম বলতে পারে।ফুটবলের কারণে লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ আমাদের কাছে বেশ পরিচিত। আর বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক আফ্রিকা বলতে আফ্রিকা দেশকেই বুঝে।আর ট্রল করার জন্য উগান্ডার নাম জানে।

কিন্তু ৬১ দেশের এই মহাদেশের বিশটির বেশি দেশের নাম একাধারে আমিও বলতে পারবো না।এইসব দেশে বা অঞ্চলে অনেক ঘটনাই ঘটে কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকা আর এশিয়ায় মত এত নজর কাড়ে না।পাড়ার গলির দোকানের চা বিক্রেতা মজিদ মিয়াও ইউক্রেন যুদ্ধের খবর রাখেন। প্রযুক্তির ব্যাপক উৎকর্ষের কারণে এখন চিত্র কিছুটা পাল্টাচ্ছে।কিন্তু তারপরও বিশ্ব রাজনীতিতে এশিয়া,ইউরোপ আর আমেরিকাই ক্রীড়নক। এই রাজনীতিতে ধর্ম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্ট।কিন্তু যারা রাজনীতির ঘুটি বদলান তাদের কাছে ধর্ম আরেকটি ঘুটি ছাড়া কিছুই নয়। ওবামার নামের মধ্যাংশে হোসেন থাকায় তার ক্ষমতা প্রাপ্তিতে নিপীড়িত মুসলিম বিশ্বের একাংশ এবং এই বঙ্গমুলুকের বৃহদাংশের নিভু নিভু আশার সলতে তেল পেয়েছিল।

কিন্তু সেই তেল সলতে বেয়ে উপরে উঠার আগেই কর্পূরের মত উবে যায়। বারাক হোসেন ওবামার আমলেই বলিউডের বাদশাহ খ্যাত শাহরুখ খান তার নামের অন্তে “খান” থাকার কারণে ইউএসএর বিমানবন্দরে কয়েক ঘন্টা আটকে ছিলেন। মুসলমানদের প্রতি এই হল তাদের ধারণা।কিন্তু জনগণ কি ধারণা পোষণ করে তা দিয়ে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত খুব কমই বাস্তবায়িত হয়।মুসলমানদের শাসনামলের স্বর্ণযুগ গত হয়েছে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে।আর আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের রেনেসাঁস এখন দূর ইতিহাসের অংশ।কিন্তু হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদের আকুলতা ছাড়া আর অবশিষ্ট কোন চেষ্টা নেই।প্রতি একশো বছর পর পর নাকি বিশ্বের মোড়লপনার নাটাই হাতবদল হয়।এমন একটা গালগল্প ফেসবুকের কল্যাণে ইদানীং শুনছি।অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর সে একশো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। তাই প্যাণ্ডেলের নিচ থেকে একটা আশার বাণী ছড়ানো হচ্ছে।অনেকে তো রিসেপ তাইপ এরদোয়ান এর পতাকাতলে সেই খেলাফতের পতপত ধ্বনি শুনতেও পাচ্ছিলেন।কেউ কেউ আবার পাকিস্তানের ইমরান খানকেও মুসলিম বিশ্বের অধিনায়কত্ব দিতে দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু আট-দশটি দেশের মধ্যে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বকাপ জেতা যত কঠিন তার চেয়ে অনেক কঠিন একটি দেশের নেতৃত্ব পাওয়া। আরও কঠিন সেই নেতৃত্ব বজায় রাখা।তাই ইমরান খান সাহেব রাশিয়া থেকে ফিরে এসেই দেখেন তার মসনদের খুটি ধরে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে। আর পশ্চিমের অঙ্গুলি হেলনে মাত্র একমাসের মধ্যেই তার মসনদের খুটি ভেঙে গেল।

আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় আমেরিকা, বৃটেন,চীন,রাশিয়া কিংবা ভারত কেউই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ধর্মভিত্তিক ঐক্যের ডাক দেয় না। এই সুর শুধু ক্ষীণ স্বরে আমাদের মাঝেই বাজে।আমরা বনাম বাকি বিশ্ব এই কল্পিত দ্বন্দ্ব যুদ্ধের স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন নিয়ে আমরা ঘুমুতে যাই।যদি সত্যিই এমন কিছু একটা করতে চাই তবে মধ্যপ্রাচ্য ও আরব পেনিনসুলার সব রাষ্ট্র এক পতাকাতলে আসতে হবে।তারপর আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রাযুক্তিক দক্ষতার দিকে ধাবিত হতে হবে।কিন্তু মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর ভিতরেই অন্তহীন বিভাজন। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিভাজন তো পাহাড়সম। এই অবস্থা চলতে থাকলে বর্তমান একশো বছর অতিবাহিত হয়ে আরও কতটি শতবর্ষ যে অতিবাহিত হবে তার কোন ইয়ত্তা নেই।

শুরু করেছিলাম মার্কিনীদের অজেয় থাকার নেপথ্য কারণগুলো সম্পর্কে আলোচনার কথা বলে। শেষদিকে এবিষয়ে বলতে চাই মার্কিনীরা অজেয় কারণ তাদের সামরিক সক্ষমতা, ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগামিতার কারণে।

লেখকঃ ব্রাঞ্চ ম্যানেজার, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Created with Visual Composer