বন্যায় বিপর্যস্ত সারাদেশঃ আমাদের পথ আটকে দেবার সংস্কৃতি

নদীমাতৃক ও ভাটি অঞ্চলের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। আমরা তো অস্বীকার করতে পারি না এই চরম সত্যকে। আমরা স্বীকার করি বা না করি পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণায়মান রীতির মতই এটা সত্যই থাকবে। ভাটি অঞ্চলের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট হলো অতি বৃষ্টি বা উজানের ঢলে এ অঞ্চল প্লাবিত হবে। যুগে যুগেই আমরা বাঙালীরা নদী ভাঙা, বানভাসী শব্দগুলির সাথে যথেষ্ট পরিচিত। সাম্প্রতিক সারাদেশে বিশেষভাবে সিলেটের বন্যা বা ব্যাপকভাবে স্থলভূমি প্লাবিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। সার্বিকভাবেই মানুষের দুঃখ দুর্দশার সীমা নেই। প্রয়োজনের তুলনায় যে সাহায্য সহযোগিতা সরবরাহ হচ্ছে তা অপ্রতুল। সরকার সাধ্যানুযায়ী জনগণের পাশে থাকার চেষ্টা করছে। উদ্ধার কাজে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগাচ্ছে। জনসাধারণের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে সমানতালে। বিষয়গুলো হৃদয়ে স্বস্তি দেয়। কিন্তু মৃত্যুর মত চরম বিষয়গুলোকেও আমরা অস্বীকার করার চেষ্টা করছি। ভাটি অঞ্চলের দেশ হওয়া স্বত্তে¡ও আমাদের নদী-নালা, হাওর-বাওর, খাল-বিলকে অস্বীকার করি। অস্বীকার করি বলেই তাদের নিজস্ব গতি পথকে আটকে দেই। তাদের মৃত্যুকে নিশ্চিত করতে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করতে মুটে দ্বিধাবোধ করি না। জাতীয়ভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে আমরা নদীগুলোর চলার পথকে বাধাগ্রস্ত করে নদীগুলোকে মৃত্যুর মুখে পতিত করেছি। নদীর গভীরতা কমে নদীতল তীরের সমপর্যায়ে চলে এসেছে। সমতল ভূমি হয়ে গেছে অনেক জায়গাতেই। ফলশ্রতিতে নদীর জমি কেড়ে নিয়েছে দস্যুরা। হাওর বাওরের উপর অযাচিত বাধ তৈরী করেছি। এক্ষেত্রে পানির ইচ্ছেগুলিকে চরম হেয়ালীর সাথে অবজ্ঞা করা হয়েছে এবং পিষ্টে মারা হয়েছে। আর এসবই করা হয়েছে উন্নয়নের নামে। জনসাধারণ শুধু চোখের সামনের উন্নয়নকেই দেখতে পেয়েছে। কিন্তু অলক্ষ্যে যে কত বড় সর্বনাশ আমরা করে ফেলেছি তার খবর কেউ রাখিনি। প্রকৃতির সাথে যাচ্ছেতাই করার প্রতিফল যে কত ভয়ানক হতে পারে তা আমরা বিস্মৃত হয়ে গেছি।

শুধু যে নদীর পথ আটকে দেয়া, তাই নয়, বরং আমাদের বাঙালীদের জীবনে অদ্ভুত এক সংস্কৃতিই ঠাই করে নিয়েছে। সংস্কৃতিটি হল যে কোন বিষয়ে যে কারো স্বাভাবিক পথ আটকে দেয়া। আমরা অনেক সময় আঞ্চলিক বিরোধের সময় দেখি যে দল শহরে কাছাকাছি থাকে তারা অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী এলাকার পথ আটকে দেয়। মাঝে মাঝে হুংকার দেয়, ‘দেখি তোরা কোনদিক দিয়ে বাজারে যাস’। ক্রমশ এই পথ আটকে দেয়ার সংস্কৃতি সমস্ত জায়গায় সম্প্রসারিত হয়েছে। একজন গুণী আর্টিস্টের কথাই ধরুন না। আর্টিস্ট খুবই ভাল গান গায়। এমন গুণগ্রাহী শিল্পি পাওয়া মেলা ভার। সারাদেশে নিজের অত্যন্ত ক্যারিশম্যাটিক গুণের কারণে বিশেষ ভক্ত শ্রেণীরও আইডল তিনি। হঠাৎ তাকে একটি বড় রাজনৈতিক পদ সম্মানসূচক প্রদান করা হল। এরপর ক্ষমতার মোহে এই পদ-পদবীই তার মূল লক্ষ্য হয়ে দাড়াল। ঠিক এভাবেই তার চলার পথে বাধা প্রদান করা হল এবং ক্যারিশম্যাটিক শিল্পের মৃত্যু হল। একজন উচুমানের খেলোয়াড়। কোটি মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন। তাঁকে তাঁর পথে চলতে দেয়া উচিত। সাময়িক পদ-পদবীর গ্ল্যামার লাইফ গ্রহণ না করে বরং খেলা সংক্রান্ত বিষয়াবলীকে আরও কত উচ্চস্থানের নিয়ে যাওয়া যায় তার পথ তৈরী করা উচিত। ঠিক একইভাবে একজন শিক্ষক, একজন গবেষক, একজন প্রযুক্তিবিদ বা একজন অভিনয় শিল্পীর পথকে আটকে দেয়ার সংস্কৃতি বর্জন করতে হবে। বরং প্রত্যেকে যেন তার নিজস্ব ক্ষেত্রে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে তার কর্মকে এগিয়ে নিতে পারে। প্রয়োজনে সরকারকে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি অন্যান্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে যাতে তার শিল্প বা গবেষণা কোন ধরনের বাধাগ্রস্থ না হয় এবং অন্যান্য ক্ষুদে শিল্পি ও গবেষকদের চলার পথও আশাব্যাঞ্জক করে তোলে।

সাম্প্রতিক সময়ে আরও একটি নতুন কায়দায় কিছু মহৎ পেশার পথ আটকে দেয়া হচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যন্ত সেরা ছাত্ররা অনেক সংগ্রামের পর দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বুয়েট বা মেডিকেলে ভর্তি হয়। কিন্তু পাশ করার পর সেই মহৎ পেশায় জীবন না গড়ে প্রশাসনিক পদে চাকুরীতে যোগদান করছে এবং ভয়ানক ব্যাপার হল এর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। এখানেও কোন না কোনভাবে তাদের চলার পথকে আটকে দেয়া হচ্ছে যা মূলত পথ আটকে দেয়ার সংস্কৃতিরই সম্প্রসারিত রূপ। এভাবেই আমরা প্রতিনিয়ত দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে এবং লক্ষ্য অর্জনে পথ আটকে দিচ্ছি। পথ আটকে মাদরাসা পড়–য়াকে বাধ্য করছি স্কুলে পড়তে, স্কুল পড়–য়াকে মাদরাসায়, সায়েন্স পড়–য়াকে আর্টসে, আর্টস পড়–য়াকে বিজনেসে। যে ছেলেটা হতে পারত একজন ভাল গল্পকার তাকে পথ আটকে বানিয়ে দিচ্ছি ব্যাংকার। ঠিক এভাবেই আমাদের এই সংস্কৃতি সম্প্রসারিত হচ্ছে।
আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নয়ন ঘটছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছে এসবই ইতিবাচক খবর আমাকে আনন্দিত করে। কিন্তু দেশের এই সামগ্রিক উন্নয়ন তা যেন কোনভাবেই কারো পথ আটকে না হয়। প্রকৃতির পথ যেন আটকে না যায়। নদীগুলোর পথ যেন আটকে না যায়। প্রয়োজনের তাদের পথ চলার জন্য বাজেটে আর্থিক বরাদ্দ রেখে যাত্রা মসৃণ করা হোক। কল কল শব্দে বয়ে চলুক পানির স্রোত ধারা। পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নির্মিত হোক স্থায়ী টেকসই উন্নয়ন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Created with Visual Composer