বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মবহির্ভুত নিয়োগের অভিযোগ

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের টপকে নিয়মবর্হিভুতভাবে আইকিউএসি সেলে অতিরিক্ত পরিচালক নিয়োগের অভিযোগ উঠেছে। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রহিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকরা এ নিয়ে অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগ, উপাচার্যের সঙ্গে লবিংয়ের জোরে নিয়মবর্হিভুতভাবে এ পদ বাগিয়ে নিয়েছেন রহিমা। ২০১৫ সালে প্রভাষক পদে যোগদান করার কয়েক মাসের মধ্যেই সাবেক ভিসি ড. ইমামুল হকের বদান্যতায় অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি বাগিয়ে চমক সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে রহিমা নাসরিনই একমাত্র শিক্ষক, যিনি এত অল্প সময়ে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হন।

অনেক শিক্ষক ৫ বছরেও যেখানে প্রভাষক হতে সহকারী অধ্যাপক হতে পারেনি, সেখানে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই এ পদোন্নতি সেইসময় শিক্ষক মহলে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি করে।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ২০১১-১২ সেশনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। আইকিউএসি সেলে একাডেমিকভাবে সিনিয়র ও দক্ষ শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও প্রতিষ্ঠালগ্নে যোগদান করা সিনিয়র, অভিজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকদের আমলে আনা হয়নি। এমনকি ১০ জন সিনিয়র শিক্ষকের তালিকা পাঠিয়ে তাদের একজনকে অতিরিক্ত পরিচালক নিয়োগের সুপারিশ করা হলেও তাদের কাউকেই নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সেই তালিকায় থাকা একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন, ‘ভিসি স্যারের দপ্তরে এক বছর আগে ১০ জন সিনিয়র শিক্ষকের নাম পাঠানো হয়েছে বলে জেনেছিলাম। সে তালিকায় আমার নামও ছিল। হঠাৎ সিনিয়র শিক্ষকদের তালিকায় ৫০ জনের মধ্যেও নেই এমন একজন জুনিয়র ও অযোগ্য শিক্ষককে এ পদে নিয়োগ দেওয়ায় অবাক হয়েছি।’


ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় কার্যকালের ভিত্তিতে সিনিয়র একাডেমিক সদস্য এবং কোয়ালিটি এস্যুরেন্স কার্যক্রম পরিচালনা ও ম্যানেজমেন্টের জন্য যোগ্য, দক্ষ শিক্ষককে এ পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব কোনো যোগ্যতাই রহিমা নাসরিনের নেই বলে নিশ্চিত করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সিনিয়র শিক্ষক।
রেজিস্ট্রার দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সিনিয়র ১০ জন শিক্ষকের তালিকায় আছেন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দীন, মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ হাসিনুর রহমান, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল মাসুদ, গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হেনা রাণী বিশ্বাস, ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. তানভীর কায়সার, ইয়াসিফ আহমেদ ফয়সাল, তরিকুল হক, মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নুসরাত জাহান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছাদেকুর রহমান ও লোকপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসনুভা হাবীব জিসান। এদের প্রায় সবাই একাডেমিকভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ।
ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, অতিরিক্ত পরিচালক পদে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বা ন্যুনতম সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইজন অধ্যাপকের একজন আইকিউএসি পরিচালক, রেজিস্ট্রার ও ডিন ড. মুহসিন উদ্দীন। রেজিস্ট্রার, ডিন, প্রভোস্ট, প্রক্টর বা এ ধরনের পদে থাকলে আইকিউএসি পরিচালক হিসেবে নিয়োগের সুযোগ নেই। অপর অধ্যাপক ড. হাসিনুর রহমান চিকিৎসা ছুটিতে দেশের বাইরে আছেন, শিগগীরই তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে। এমন সময় হুট করে একজন জুনিয়র শিক্ষককে অতিরিক্ত পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়ায় নানা প্রশ্ন ও গুঞ্জন উঠেছে।


রহিমা নাসরিনের স্বামী বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার অপারেটর সাইফুল ইসলাম তৃতীয় শ্রেনীর চাকরিতে ঢুকলেও অনেক অনুনয় বিনিনয় করে ও হাতে-পায়ে ধরে স্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে চাকরিতে ঢোকান। নিজেও ক্যারিশমা দেখিয়েছেন। বিগত ভিসির আমলে তৃতীয় শ্রেনীর কর্মচারী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা (প্রশাসনিক কর্মকর্তা) হয় তদবিরের জোরে। কিছুদিন পরেই প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে আরেক লাফে সেকশন অফিসার পদে পদোন্নতি বাগিয়ে নেয়। অথচ তৃতীয় শ্রেনীর কর্মচারী তো দূরের কথা, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কর্মকর্তা শুরুর দিকে যোগদান করেও কোন পদোন্নতি পাননি। শুরু থেকে যে পদে ছিলেন, সে পদেই চাকরি করছেন।
কোন যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রহিমা নাসরিন অতিরিক্ত পরিচালক পদে নিয়োগ পেলেন, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষকদের মধ্যেই। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে জয়েন করা একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘অনেক যোগ্য, অভিজ্ঞ, দক্ষ ও সিনিয়র শিক্ষক থাকার পরও কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি সেলে একজন জুনিয়র শিক্ষককে নিয়োগ দিতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট, প্রশিক্ষনসহ সব শিক্ষককের নিয়ে যেখানে কাজ করতে হবে, সেখানে সিনিয়রদের একজনকে নিয়োগ দেওয়া উচিত ছিল।’
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে প্রায়ই খারাপ ব্যবহার ও হুমকি-ধামকি দেওয়ার অনেক অভিযোগ রয়েছে রহিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে। সবার সঙ্গে দুর্ব্যাবহার করে ও অকারনে সহকর্মীদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করার বিষয়ে সিদ্ধহস্ত তিনি। সাবেক ভিসি ইমামুল হকের আমলে বিভাগের চেয়ারম্যান থাকার সময় সহকর্মী শিক্ষকদের সঙ্গে নানাভাবে খারাপ আচরণ করতেন ও ভিসির কাছে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতেন রহিমা।


বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র একজন শিক্ষক নেতা জানান, সব ভিসির আমলে সুবিধা নিয়ে আসছে রহিমা নাসরিন। দ্রুততম সময়ে অনিয়ম করে সহকারী অধ্যাপক হওয়া নিয়ে ব্যাপক বিতর্কিত হয়েছিলেন তিনি। লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক হোসনে আরা ডালিয়া প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হয় ৫ বছরে। জিওলজি বিভাগের ইলিয়াস মাহমুদসহ অনেক শিক্ষকেরই প্রায় একই সময় লেগে যায়। কেবল উপাচার্য অধ্যাপক ইমামুল হকের সঙ্গে ঘনিষ্টতার জোরে মাত্র কয়েক মাসের মাথায় সহকারী অধ্যাপক হয়ে রহিমা নাসরিন চমক দেখান। এখন বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ছাদেকুল আরেফিনের সময় তার ঘনিষ্ট হয়ে সিনিয়র শিক্ষকদের পেছনে ফেলে আইকিউএসি সেলের মতো গুরুত্বপুর্ন দপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক পদে নিয়োগ পেলেন তিনি। শিক্ষকদের প্রশ্ন, কি তার জাদু! সেই জাদুতে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে তুমুলভাবে সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েও সব ভিসির কাছের লোক হয়ে যায় রহিমা নাসরিন।
সিনিয়র এ শিক্ষক নেতা আরও বলেন, ‘এ সেলে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকদের সঙ্গে কাজ করতে হবে রহিমা নাসরিনকে, এ যোগ্যতা তার নেই। নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ তাকে পছন্দ করে না। বিতর্কিত শিক্ষককে এমন একটি পদে দেওয়া উচিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত হবে তার পরিবর্তে যোগ্য, সিনিয়র, ব্যবস্থাপনা দক্ষতাসম্পন্ন ও সবার সাথে মানিয়ে নিতে পারেন এমন কাউকে নিয়োগ দেওয়া।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Created with Visual Composer