বড় ভোগান্তির ইঙ্গিত দিয়ে গেল তিন ঘণ্টার বৃষ্টি

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ চলছে, যানজটের এ শহরে শিগগিরই মুক্তি মিলবে জলজটের বিড়ম্বনা থেকে- এমন প্রতিশ্রুতি প্রতিবছরই শুনছে ঢাকার মানুষ। এ শহরের মানুষকে জলজট থেকে মুক্তি দিতে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খালের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশন বুঝে নিয়েছে প্রায় পাঁচ মাস আগে। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে মাত্র তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতেই বেরিয়ে এসেছে জলাবদ্ধতার পুরোনো চিত্র।

প্রতিবছর জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে মুক্তির এত আশ্বাস, এত চেষ্টার পরও এ থেকে মুক্তি কেন মিলছে না? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যবস্থাপনা না থাকায় ঢাকায় জলাবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে না। শুধু খাল উদ্ধার ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন নয়, সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে ঢাকার গাছপালা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের মধ্যে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার সমন্বয় জরুরি। তা না হলে অপরিকল্পিত ভূমি উন্নয়ন, দখল ও ভরাটের ফলে জলাধার কমে যাওয়ার মাশুল হিসেবে জলাবদ্ধতা আরও প্রকট হয়ে উঠবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে সেই অর্থে কোনো রোডম্যাপই নেই। ফলে ঢাকার মেয়রদের প্রতিশ্রুতি শুনে শুনেই দিন পার করতে হচ্ছে ঢাকাবাসীকে।

বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পানি প্রবাহের ব্যবস্থাপনা ২০ বছর আগেই পরিবর্তন করেছে। আমাদের দেশে শুধু খাল পরিষ্কার আর উদ্ধারের মধ্যেই ব্যবস্থাপনা সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। ফলে সমস্যার সুরাহা হচ্ছে না।

মঙ্গলবার সকালে মাত্র তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতেই বেরিয়ে এসেছে জলাবদ্ধতার পুরোনো চিত্র। ছবি : ঢাকা পোস্ট
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলেই ঢাকা আজ মুমূর্ষু। শুরুতেই ভুল করা হয়েছে। একের পর এক ভূমি উন্নয়ন করা হয়েছে। কিন্তু পানি প্রবাহের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি মাথায় রাখা হয়নি। জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নেই। আর যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয় সেগুলো বিজ্ঞানসম্মত নয়।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হলেও সমাধান হচ্ছে না কেন? কারণ, ঢাকার জলাধার ভরাট করা হয়েছে। সরকারের চোখের সামনেই তা হয়েছে। খাল দখলের ফলে অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। এখন খাল উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু ফলাফল দেখা যাচ্ছে না। মাটিতে পানি শোষণের ব্যবস্থাও ধ্বংস করা হয়েছে।

কেমন ছিল আজ (মঙ্গলবার) সকালের পরিস্থিতি
যত দূর চোখ যায় শুধুই জলের ধারা। ঢেউয়ের সঙ্গে পেরে উঠছেন না মোটর সাইকেল চালকরা। অটোরিকশাগুলোর শরীরের নিচের অংশ আগেই ডুবেছে। চালকরা অটোরিকশা থেকে বের হয়ে পায়ে হেঁটে হাত দিয়ে ডুবন্ত অটোরিকশাগুলোকে টেনে সামনে নিয়ে যেতে লড়ছেন। যদি শুকনো জায়গা পাওয়া যায়! কিন্তু কোথায় সেই এক টুকরো শুকনো রাস্তা? প্রাইভেট কারের চালকরা সামনে যেতে পারছেন না। জমে থাকা পানি বেশি বলে উল্টো গাড়িগুলো ঘুরিয়ে নিচ্ছেন।

মঙ্গলবার সকালে ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ঢাকায়। এই বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এর সঙ্গে কাদাপানিতে অনেক এলাকার সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
সকাল ৯টায় এমন দৃশ্য দেখা গেল রাজধানীর আসাদগেট ও ধানমন্ডির বিভিন্ন সড়কে। ধানমন্ডির সড়কে জলের ধারার সঙ্গে লড়াই করে গাড়ি তো তবু চলছিল। কিন্তু বিমান বন্দর সড়কে? সেখানে গাড়ির চালকরা গাড়ি বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। কুড়িল উড়াল সেতু থেকে খিলক্ষেত নামার পথে জমে ছিল কোমর সমান পানি। ফলে উড়াল সেতুর ওপর গাড়িগুলোকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। বিমানবন্দর সড়কের জায়গায় জায়গায় সামনে চলতে না পেরে গাড়ির জট দীর্ঘ হচ্ছিল। যার প্রভাব পড়ে রাজধানীর অধিকাংশ সড়কে।

কুড়িল উড়াল সেতুর কাছে রাস্তার গা ঘেঁষেই নিকুঞ্জ লেক। উল্টো দিকে রেলপথের পাশের খাল। ভুক্তভোগীদের কারো অভিমত- ফুটপাতের নিচ দিয়ে যাওয়ার পথ করে দিলেই রাস্তার পানি লেকে চলে যেত। দমকল বাহিনীর সেচ পাম্প দিয়ে লেকে বা খালে পানি সরিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল। কোনো উদ্যোগই চোখে পড়ল না।

অন্যদিকে রাজারবাগ, মতিঝিল তো ভেসেই চলছিল। কাজীপাড়া, কালশীর সড়কেও নদীর মতো বইছিল জলের ধারা। শহর ঢাকা স্থবির ছিল জলজট ও যানজটে।

অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলেই ঢাকা আজ মুমূর্ষু। শুরুতেই ভুল করা হয়েছে। একের পর এক ভূমি উন্নয়ন করা হয়েছে। কিন্তু পানি প্রবাহের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি মাথায় রাখা হয়নি।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক
বর্ষার আগমনের পদধ্বনিতেই ভাসল ঢাকা
এবার বর্ষার আগমনের পদধ্বনিতেই জলে ভাসল ঢাকা। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য বলছে, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত টানা তিন ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ৮৫ মিলিমিটার। জলাবদ্ধতার কারণে একদিকে যেমন লড়াই করে চলতে হয়েছে গাড়িগুলোকে, অন্যদিকে এ জলাবদ্ধতা থেকে সৃষ্ট যানজটের ধকল গেছে যাত্রীদের ওপর দিয়ে।

গাড়িতে খিলক্ষেত থেকে রওনা দিয়ে সাইদুর রহমান নামে এক ব্যক্তি দুই ঘণ্টায় পৌঁছান আসাদগেটে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, এত যানজটে আর পড়িনি। ধানমন্ডি থেকে আসাদগেট হয়ে চলাচল করতে না পেরে গাড়ি ঘুরিয়ে পান্থপথ হয়ে বারিধারার কর্মস্থলে পৌঁছান অরিত্র অঙ্কন। এফডিসির সামনে, হাতিরঝিলেও জলাবদ্ধতার মুখে পড়েন তিনি।

উত্তরা ও আবদুল্লাহপুর অংশে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ চলছে। এখানে উন্নয়ন কাজের জন্য সড়কের বিভিন্ন লেন বন্ধ করা হয়েছে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও নেই। উত্তরার বিভিন্ন সড়কেও ছিল জলাবদ্ধতা।

দুপুরে মতিঝিল-টঙ্গী বিআরটিসি বাসের যাত্রী নজরুল ইসলাম বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে গাড়িতে বসেই কাটল চার ঘণ্টা। গ্রিন রোড, পান্থপথ, ধানমন্ডি, তেজতুরীবাজার, বনানীর কিছু অংশ, মহাখালীর চেয়ারম্যানবাড়ি, মালিবাগেও সড়কগুলো জলে ভেসে যেন ছোট ছোট নদীর রূপ নিয়েছিল। তেজতুরীবাজারে কোমর সমান পানি ভেঙে কর্মস্থলের দিকে ছুটছিলেন মানুষজন।

লালবাগসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দি ছিলেন মানুষ। কোথাও ছিল কোমর সমান পানি, কোথাও হাঁটুপানি। অটোরিকশা চালক হানিফ মিয়া বিকেলে ঢাকা পোস্টকে বলেন, জলাবদ্ধতা শেষ হয়েছে। তবে সকাল থেকে মালিবাগ, মগবাজারে অটোরিকশা চালাতেই পারিনি। বনানীর বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, সেতু ভবনের সামনে নদীর মতো পানি ছুটছিল।

সমাধান কোথায়?
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলছেন, ঢাকার জলাধার ভরাট করে উন্নয়ন করা হয়েছে। জলাধার কমে যাওয়া ও খাল দখলের ফলে অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। আগে সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪৪টি খাল ছিল। সেগুলো উদ্ধার করা হয়নি। কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে কিন্তু জলাবদ্ধতার সমাধান হচ্ছে না। কারণ এখানে সমন্বয় নেই।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রকৌশল এখানে কাজ করছে না। শুরুতেই ভূমি উন্নয়ন পরিকল্পনা সমন্বিত ছিল না। ব্যক্তি উদ্যোগকে সমন্বয় করা হয়নি। সরকারি সংস্থাগুলো নিজেই জলাভূমি ভরাট করেছে। আমরা আগের ভুলের ফলে এখন খাঁচার মধ্যে বন্দি হয়ে আছি। খাল পরিষ্কার করলেই সমাধান আসবে না। পানি ধারণ ও সরানোর ব্যবস্থার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাবস্থাপনা থাকতে হবে।

বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্ষার সময় জলাবদ্ধতার বিষয়টি সামনে আসে, তারপর আবার একই অবস্থা আমরা দেখতে পাই। প্রাকৃতিক পদ্ধতির সঙ্গে সমন্বয় করে আমাদের ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। বৃষ্টির পানি পড়ার পর মাটি শোষণ করবে কমপক্ষে ২০ শতাংশ, গাছপালা ধারণ করবে কিছু অংশ। কিন্তু ঢাকায় সবুজের বদলে বাড়ছে কংক্রিট। ফলে বৃষ্টির পানি শোষিত হচ্ছে না। তার ওপর পানি প্রবাহের পথ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। শুধু ড্রেনেজ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করলেই হবে না। সামগ্রিক ও সমন্বিতভাবে ব্যবস্থাপনায় না গিয়ে আমাদের ভুল ব্যবস্থাপনার ফলে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটছে না। জলাবদ্ধতা এ কারণে আরও প্রকট রূপ নেবে।

কিছুদিন আগ পর্যন্তও ঢাকা মহানগরীর প্রধান ড্রেন লাইনগুলো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার এবং শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব ছিল সিটি করপোরেশনের। ঢাকা শহরের মোট ড্রেনেজ লাইনের ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার অধীনে এবং প্রায় ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে ছিল। এছাড়া ২৬টি খাল ও ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্টের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ঢাকা ওয়াসার ছিল। গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস গত ১৯ মে নগর ভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, আগে কেউ কখনও এই সমস্যার গভীরে যাননি। খালের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে চলেছি।

ঢাকার জলাধার ভরাট করা হয়েছে। সরকারের চোখের সামনেই তা হয়েছে। জলাধার কমে যাওয়া ও খাল দখলের ফলে অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। এখন খাল উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তার ফলাফল বেশি দেখা যাচ্ছে না।
পবা চেয়ারম্যান আবু নাসের খান
জলাবদ্ধতা নিরসনে কী করা হচ্ছে
ওয়াসার কাছ থেকে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেওয়ার পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বিভিন্ন খাল থেকে স্কেভেটর ব্যবহার করে ১১ হাজার ৬৩৮ টন ভাসমান বর্জ্য অপসারণ করেছে। ঢাকা ওয়াসা থেকে পাওয়া ১৮০ কিলোমিটার স্ট্রর্ম স্যুয়ারেজ ড্রেনের মধ্যে ৯৪.৭১ কিলোমিটার ড্রেন পরিষ্কারের জন্য ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫টি আঞ্চলিক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে মগবাজার, মধুবাগ, কারওয়ান বাজার, উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরসহ বনানী রেলগেট থেকে কাকলী মোড় পর্যন্ত ড্রেন নির্মাণ, পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Created with Visual Composer