শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: সেই ভাষণই উন্নয়নের প্রত্যয়

১৭ মে, ১৯৮১ রবিবার। সূর্য উঠার সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলার মানুষ জেগেছে। ভাঙা স্বপ্ন পূরণে যেন এক ত্রাতার অনুসন্ধান পেয়েছে। ৫ বছর ৯ মাস ৩ দিন আগে জাতির পিতা শেখ মুজিব সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাঙালীর স্বপ্ন ভেঙে দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদীদের প্ররোচনায় বাঙালী ষড়যন্ত্রকারীদের এক মর্মান্তিক আঘাতে স্তিমিত হয়ে পড়ে বাংলাদেশের পথচলা। দ্রব্যমূল্যের চরম উর্ধ্বগতি, ছিনতাই-রাহাজানী, আইন শৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি, সর্বোপরি সদ্য স্বাধীন দেশের সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের উপর গুপ্ত ও প্রকাশ্য হত্যাকাÐ জনমনে ব্যপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। তাই আজকের সূর্য যেন নতুন আলো নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। এই আলোয় ভাসিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতা কর্মীকে। বিনিদ্র রজনীতে শুধু একটি ভাবনাই তাড়িয়েছে, ঠিক কোন সময়টাতে বাংলাদেশের নবমুক্তির ত্রাতা, বঙ্গবন্ধুর দুহিতাকে দুনয়নে দেখতে পাব। দেশের সার্বিক অরাজক পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আসবেন আমাদের কাক্সিক্ষত নেতা শেখ হাসিনা। সরকারের সহযোগিতায় দেশব্যাপী ব্যপক অপপ্রচার, চরম নিরাপত্তাহীনতা, মুক্তিযুদ্ধ বিরোদ্ধবাদীদের উল্লম্ফন, শেখ হাসিনা প্রতিরোধ কমিটির বাঁধা বিপত্তি উপেক্ষা করে দেশের মাটিতে পা রাখবেন বঙ্গবন্ধু দুহিতা। কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে জানানো হবে অভ্যর্থনা এবং শেরে বাংলা নগর মানিক মিয়া এভিনিউতে গণসংবর্ধনা।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক অভ্যর্থনা ও গণসংবর্ধনা সুশৃঙ্খল করতে নোটিশ জারি করেছেন। দুপুর একটায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে দলীয় নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকবৃন্দ মোটর সাইকেল, গাড়ী ও ট্রাক যোগে ১১ কিলোমিটার দূরে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে রওয়ানা হবে। এই বহর বিমান বন্দরের ভিতরে প্রবেশ করলেও এই বহরের বাইরে যারা থাকবে তারা বিমান বন্দরের বাইরে ময়মনসিংহ রোডে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করবেন। কিন্তু এই সমস্ত নোটিশ যেন সেদিন শুধু কাগজেই ছিল। বাস্তবতায় দুপুর বারটা থেকেই পুরো বিমান বন্দর এলাকায় উপচে পড়া জনতার ভীড় হয়ে যায়। রানওয়ে, টারমার্ক, বিমান বন্দর চত্বর থেকে শেওরাবাড়ী পর্যন্ত কোন জায়গায় ন্যূনতম জায়গা ফাকা নেই। স্বেচ্ছাসেবীদের প্রধান সৈয়দ আহমদ ও মোহাম্মদ হানিফ বারবার মাইক হাতে ঘোষণা দিচ্ছেন রানওয়ে, টারমার্ক ছেড়ে যাবার। নিয়ন্ত্রণ ব্যুহ ভেঙে পড়ায় পুলিশ বারবার লাঠি চার্জ করেও শেখ হাসিনাকে একনজর চোখে দেখার আবেগ থেকে তাদের ফেরানো যাচ্ছিল না। জনতার ভীড়ের মতই যেন উপচে পড়ছিল প্রতিটা জনতার আবেগ। পাগলপ্রায় মুক্তিকামী জনতা কোন বাঁধা-বারণ মানতে রাজী নয়। নতুন করে যেন ৯ বছর ৩ মাস ৭ দিন আগের ১০ জানুয়ারী জাতির পিতার স্বাদেশ প্রত্যাবর্তনের দৃশ্যের অবতারনা হচ্ছে এখানে।

১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১ সালে দেশকে ষড়যন্ত্রের রাহুগ্রাশ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু দুহিতাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করেন। তাঁরা শেখ হাসিনার মাঝেই বঙ্গবন্ধুকে খোঁজে পান। এরপর থেকেই মূলত তাঁর সাথে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। কয়েকদফা নেতৃবৃন্দ ভারতেও গমন করেন। দলীয় প্রধানকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কোরবান আলী এবং আব্দুস সমাদ আজাদ নয়াদিল্লী গিয়েছেন। নয়াদিল্লী থেকে কলকাতায় ১৭ মে রবিবার আসার কথা থাকলেও নিরাপত্তার স্বার্থে শনিবারেই রাত দশটায় কোলকাতা এসে পৌছায় দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এসময় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও উপস্থিত ছিলেন। পুরো এলাকা ছিল নিরাপত্তার চাদরে ঘেরা। শুধু নির্দিষ্ট কিছু সাংবাদিক ব্যতীত অন্যদের প্রবেশে ছিল সীমবদ্ধতা। রবিবার কোলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে বোয়িং ৭৩৭ দুইটা পঁচিশ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও বিমানটি ছাড়তে হয় তিনটা নাগাদ। সমস্ত যাত্রীদের উঠিয়ে নিরাপত্তা জনিত সমস্ত চেক-আপ সম্পন্ন করার পর শেখ হাসিনাকে বিমানে নির্ধারিত স্থানে বসানো হয়। কারণ তখনও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কুচক্রী তাঁকে হত্যা করার পায়তারা করছিল। অবশেষে সমস্ত জল্পনা কল্পনা সমাপ্তি করে সাদা রঙের কালো প্রিন্টের মোটা শাড়ি পরিধান করে নিজ কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে সাথে নিয়ে বিকাল চারটায় কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে পৌছলেন বাংলাদেশের নতুন অবতার।

বোয়িং ৭৩৭ ঢাকার আকাশে দেখা যাওয়া মাত্র নেতা-কর্মীসহ সর্বস্তরের জনতা নিরাপত্তা জনিত সমস্ত ব্যুহ ক্ষুন্ন করে চলে যান কুর্মিটোলা বিমান বন্দরের রানওয়েতে। পরিস্থিতি এমন হলো যে, বিমান অবতরনই অসাধ্য হয়ে গেল। সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ও নিরাপত্তকর্মীদের বিশেষ অনুরোধে শেষ পর্যন্ত কোনমতে বিমানটি রানওয়েতে অবতরণ করানো সম্ভব হয়। বিমানের দরজা খোলে সামনে আসতেই এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। সমস্ত নেতাকর্মীরা সমস্বরে শ্লোগান ধরে, “হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব।”, “মুজিব হত্যার পরিণাম, বাংলা হবে ভিয়েতনাম।” এসময় বঙ্গবন্ধু কন্যা গগনবিদারী চিৎকার করে কান্নায় দুহাত বাড়িয়ে বলে উঠেন, ‘হায় আল্লাহ! কেন আমাকে এখানে আনিলে?”

দুপুর তিনটা থেকেই ঢাকার আকাশে কাল-বোশেখী মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আসে। বিমান অতরনের সময় যত ঘনিয়ে আসে ততই ঝড়ের আশঙ্কা বাড়তে থাকে। যখন ঘড়িতে চারটা বাজল, নেত্রী ডান পাশে শেখ সেলিম, সাজেদা চৌধুরী এবং বাম পাশে আইভি রহমান ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতাসমেত খোলা ট্রাকে জনতার উদ্দেশ্যে দাড়ালেন, ঠিক তখনই নেমে এল ঝুম বৃষ্টি আর ঝড়। সেদিনের ঝড় অনেকের ঘর-বাড়ীসহ অনেক কিছু উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল, শুধু উড়িয়ে নিতে পারেনি আবেগ। আগত জনসাধারণ স্থির দাঁড়িয়েছিল। চোখের পলক যথাসম্ভব দীর্ঘায়িত হয়েছিল। এযেন অত্যাচারীর হাত থেকে বাঁচাতে এক ঐশ^রিক ত্রাতার সাক্ষাত অবতরন। এমনই ঐশ্বরিক মুহুর্তকে সাথে করে নিয়ে বিমানবন্দরের ফটক পেরিয়ে বনানী গোরস্থানের দিকে ছুটে চলেছে জনতার বহর। যেখানে শুয়ে আছে বেগম মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলরা। ঘোষণা দেয়া হল, গোরস্থানে কোন শ্লোগান বা মাইক্রোফোন বাজবে না। নীরব হয়ে থমথমে হয়ে গেল জনতার মুখ, কলকলিয়ে বৃষ্টির সাথে কান্নার জল মিলেমিশে ফোয়ারা সৃষ্টি করে চলেছে অগোচরে। নেত্রীর হাওমাও চিৎকারের শব্দকে ঝড়ের বাতাসের প্রচন্ড শক্তিও হারিয়ে দিতে পারেনি। মায়ের কবরের পাশে চিৎকার করে শেখ হাসিনা বলে উঠলেন, ‘মা, আমাকে রেখে গেলে কেন?’

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস

৬০ কিলোমিটার বেগে কালবোশেখী ঝড় বয়ে গেছে। মুষলধারে বৃষ্টি। দেশের উত্তরাঞ্চল ব্যপক ক্ষতিগ্রস্থ। চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মানুষ নিহত হয়েছে। গৃহহীন হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। রাজধানীর রাস্তাঘাটে জলাশয়। বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রাজধানীর প্রতিটি এলাকা। রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, শেরেবাংলানগরসহ বিভিন্ন এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন বিদ্যুতের অভাবে। রাস্তার পাশের লাইটগুলো সেদিন জ¦লেনি। সকল প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে কয়েক লাখ মানুষ তখনও অপেক্ষায়। কুর্মিটোলা থেকে শেরেবাংলা নগরের দূরত্ব যে পথ তা অতিক্রম করতে সর্বোচ্চ ত্রিশ মিনিট লাগতে পারে, সেখানে প্রায় তিন ঘন্টা যাবৎ ঝড়ো বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে শেখ হাসিনাসহ নেতৃবৃন্দ এসে পৌছালেন। বিদ্যুৎ আসার জন্য অপেক্ষা করা হলো। সাউন্ড সিস্টেম এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কিছুটা ঠিকঠাক করা হলো। বঙ্গবন্ধু দুহিতা যখন মঞ্চে উঠলেন তখন ঘড়িতে সাড়ে সাতটা। ঘুট ঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মঞ্চে একটি হ্যাজাক বাতি জ¦ালানো হলো। কিন্তু তার যে আলো, তাতে একটি সলতে কোনমতে জ¦লছে এমন অনুভূত হলো। নেতা কান্নাভেজা কণ্ঠে সামনে দাঁড়ালেন। বললেন গণমানুষের হৃদয়ের কথা। তুলে ধরলেন দেশবাসীর নানাবিধ দুর্ভোগের কথা। বর্ণনা দিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের উপর গুপ্ত ও প্রকাশ্য হামলার কথা।

প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুল মালেক উকিলের সভাপতিত্বে শেরে বাংলা নগরের গণসংবর্ধনায় শেখ হাসিনা ভাষণে বলেন, “বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমার আর কিছু পাবার নেই। সব হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি আপনাদের ভালবাসা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্টা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।” স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনের ভাষণের এই কথাগুলো আজও প্রেরণা দেয়, আজও এগিয়ে চলার পাথেয় হিসেবে বিবেচিত। সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নকল্পে প্রতিদিনের ভোর হয়। সে প্রত্যয়েই উন্নত বাংলাদেশ গড়তে আওয়ামী লীগের বিরামহীন পথচলা।

লেখক: এম. রাশিদুজ্জামান, সহকারী গ্রন্থাগারিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Created with Visual Composer