স্বপ্নের পদ্মা সেতুঃ বঙ্গবন্ধু কন্যার রাজনৈতিক সততার প্রকৃষ্ট উদাহরণ
হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গঙ্গা নদীর প্রধান শাখা নদী পদ্মা নাম ধারন করে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা দিয়ে প্রবেশ করেছে যা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলাকে পৃথক করেছে। গঙ্গা নদীর অন্য যে শাখাটি পশ্চিমবঙ্গের দিকে প্রবাহিত তার নাম ভাগীরথী। বাংলাদেশে প্রবাহিত প্রমত্তা পদ্মা একশত বিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে যার গড় প্রস্থ দশ কিলোমিটার। উৎপন্নস্থল থেকে ২২০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরের উপকূল চাঁদপুরে মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।
আবহমানকাল ধরে এই পদ্মা বিভিন্ন সময়ে তার গতিপথ যেমন বদল করেছে তেমনি তার নামও পরিবর্তন করেছে। পদ্মার পূর্ব নাম ছিল কীর্তিনাশা। নাম শুনেই আমরা ঠাহর করতে পারছি বাংলার গণমানুষের কত কীর্তিই হয়ত বিলীন হয়ে গেছে পদ্মার গর্ভে। ১৯৬৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৫৬ বর্গমাইল জায়গা হারিয়ে গেছে পদ্মা ঢেউয়ে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে অন্যতম দীর্ঘ নদী পদ্মা যার ¯্রােতের খরতা বিশ্বের সর্ববৃহৎ নদী আমাজনের পরই। হাজারও কীর্তি হরনকারী হলেও পদ্মাকে ঘিরেই গ্রাম বাংলার জীবন প্রবাহ গতিশীল হয়ে উঠে। বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল অঙ্গন জুড়েই রয়েছে পদ্মার প্রভাব।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিন্নপত্রে পদ্মা নদীর প্রকৃতি পরিবেশ ও গ্রামীণ জীবনের স্কেস একেছেন নিবিড়ভাবে। ১৮৯১ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারী গ্রহণ করলে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজশাহী ভ্রমণের সুযোগ হয় ও গণমানুষকে দেখেন অত্যন্ত কাছ থেকে। পদ্মার নৈসর্গিক সৌন্দর্য প্রভাবিত করেছে কবি কাজী নজরুল ইসলামকেও। তাঁর অনেক গানেই পদ্মার প্রকৃতি ফুটে উঠেছে। সাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসটিও এই নদীর তীরের মানুষের জীবনকে কেন্দ্র করেই লেখা। কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাকের পদ্মার পলিদ্বীপ উপন্যাসটিরও উপজীব্য বিষয় পদ্মা পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রা।খরস্রোতা পদ্মা নদীর প্রবাহমান ধারায় রাজধানী ঢাকা থেকে পৃথক করেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি বিভাগের একুশটি জেলা যথাঃ খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুড়া, বরিশাল, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, ভোলা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও রাজবাড়ীকে। এই একুশটি জেলায় তিন কোটিরও বেশী মানুষ বসবাস করে যাদের ঢাকার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম নদী পথ বা মাওয়া-জাজিরা ঘাট অথবা পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ ঘাট। পদ্মা নদী পারাপার ব্যবস্থা অপ্রতুল হওয়ায় তিন কোটি মানুষের জীবন-যাত্রা, চিকিৎসা সেবা এবং পণ্য সরবরাহ ইত্যাদী মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয় এবং এর ফলে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতেই নিম্নমূখী প্রভাব পড়ে।
অন্যদিকে বরিশালের বাংলার শস্যভান্ডার, খুলনার মংলা পোর্ট, পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরসহ আরও অন্যান্য কলকারখানার মালামাল সরবরাহ অস্বাভাবিক ঝুকির মুখে পতিত হওয়ায় তিন কোটি মানুষের প্রাণের দাবী হয়ে উঠে পদ্মার উপর একটি ব্রীজ। পদ্মা সেতু হয়ে যোগাযোগের মাধ্যমে কৃষিজ ও শিল্প পণ্যের সরবরাহের যে উপযোগ সৃষ্টি হবে তা বাংলাদেশের জিডিপিতে অন্তত এক দশমিক তিন শতাংশ বৃদ্ধি করবে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন বিবেচনায় গুরুত্ব দিয়ে ০৪ জুলাই ২০০১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে সরকার পরিবর্তন হলে পদ্মা সেতুর মতন এমন জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পকে কেউ এগিয়ে নিয়ে যায়নি। ২০০৯ সালে আওয়ালীগ পুনরায় সরকার গঠন করলে পদ্মা সেতুর প্রকল্প নতুন করে গতি পায় এবং পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের ইচ্ছাতেই ১২০ কোটি ডলারের ঋনচুক্তি সম্পন্ন হয়। কিন্তু বাঙালী জনতার দুঃখ যেন পিছু ছাড়ে না। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে থামিয়ে দিতে একদল দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সেতুর কাজ বাঁধাগ্রস্ত করে। তাদের ভয় হয়েছিল, যদি পদ্মা সেতুর মত একটি বড় প্রকল্প বাস্তাবায়িত হয়ে যায়, তাহলে আওয়ামীলীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসবে এবং ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তিদের দোসর রাজাকার আলবদরদের মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের চলমান বিচার সম্পন্ন করবে।
আওয়ামীলীগকে হারাতে, শেখ হাসিনার পরিবারকে কলঙ্কিত করতে বাংলাদেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল, আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত কয়েকজন ব্যক্তি এবং কিছু তথাকথিত সুশীলসমাজ দেশবিরোধী এহেন চক্রান্ত করতে একটুও দ্বিধাবোধ করেনি। এই হীন ষড়যন্ত্রের জের ধরেই প্রকল্পের নির্মাণকাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কানাডার একটি প্রতিষ্ঠান এসএনসি-নাভালিনের বিরোদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ২৯ জুন ২০১২ সালে অর্থ বরাদ্দ বাতিল করে। জাইকা, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকও একই পথে হাটে। এভাবে অর্থ বরাদ্দ বাতিল করতে পারে কিনা এ প্রশ্ন আজও রয়ে গেছে। আর এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কিছু অটোমেটিক এজেন্ট, কিছু মেইড এজেন্ট আর কিছু পেইড এজেন্ট পত্রিকা, টিভি টকশোতে সরকারের ব্যবচ্ছেদ করতে থাকল। ২৩ জুন ২০১২ সালে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান ছুটিতে যান। কোন কোন পত্রিকার শিরোনাম হল, ‘পদ্মা সেতু হচ্ছে না’। বিএনপি চেয়ার পারসন বেগম খালেদা জিয়া মন্তব্য করলেন, ‘এ সরকারের আমলে আর পদ্মা সেতু হবে না।’ তিনি বললেন, ‘ পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল করায় পদ্মা সেতু না হওয়ার জন্য সরকার, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর পরিবার দায়ী।’ বিষয়টা এমন হয়ে দাড়াল যেন পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়াটা একটা আনন্দের সংবাদ। এমতাবস্থায় বাংলার মাটিতে একজন দাড়িয়ে যান। ষোলকোটি জনতার মধ্যে শুধু একজনই বিশ্বাস করেন এবং দৃপ্তকন্ঠে বলেন, ‘সম্ভব’। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তিনি আর কেউ না, তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি ২০১২ সালের ৮ জুলাই জাতীয় সংসদে নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু করার ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা যুদ্ধ করে দেশ জয় করেছি। বাংলার মানুষ কারও কাছে মাথা নত করতে জানে না। আমি আশাবাদী। আমি আত্মবিশ্বাসী।’
অনেক সমালোচনা, অনেক বাঁধাবিপত্তি অতিক্রম করে, নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে পদ্মাসেতু আজ তার সবগুলো পিলারের লাইট জ্বালিয়ে বাঙালীর অহংকার হয়ে দাড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে জমকালো উদ্বোধনের। এই সেতু দক্ষিণাঞ্চলের সাথে অর্থনৈতিক করিডোর এবং এশিয়ান হাইওয়ে হিসেবে যশোর স্থলবন্দরের সাথে যুক্ত করবে চট্টগ্রাম বন্দরকে। যার ফলে বাংলার সমস্ত অর্থনীতিতে পড়বে ইতিবাচক প্রভাব। কিন্তু যত ইতিবাচক প্রভাবই থাকুক না কেন দেশবিরোধীদের গাত্রদাহ যেন কোনভাবেই কমছে না। বিভিন্নধরনের বিদ্রæপাত্মক কথা বলে প্রকারন্তরে নিজেদেরকেই হাসির খোরাক বানাচ্ছে। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশই পদ্মাসেতুকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছেন।
লেখকঃ সাবেক উপ-দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ