ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে দেউলিয়ার পথে থাকা শ্রীলংকার মতো হতে পারে বাংলাদেশ- এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে কখনো খেলাপি (ডিফল্টার) হয়নি, হবেও না। দেশের অর্থনীতির ভিত্তি অনেক মজবুত, সরকার অত্যন্ত সতর্ক।’ বুধবার একাদশ জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

বাংলাদেশের পরিণতি শ্রীলংকার মতো হতে পারে-এমন আশঙ্কার কথা তুলে সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের বলেন, ‘বিদেশি ঋণের বোঝা বাংলাদেশ বইতে পারবে কিনা-তা নিয়ে সন্দেহ আছে।’

বিরোধীদলীয় উপনেতার এই আশঙ্কার জবাব দিয়ে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিরোধীদলীয় উপনেতা শ্রীলংকার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এটা বাস্তব। তবে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত উন্নয়নে যত ঋণ নিয়েছে, সব ঋণ সময়মতো পরিশোধ করা হয়। বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে কখনো খেলাপি (ডিফল্টার) হয়নি, হবেও না। সেদিক থেকে আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি অনেক মজবুত। সেটা আমি বলে রাখতে চাই। আমরা অত্যন্ত সতর্ক।’

বঙ্গবন্ধুর আসল খুনি জিয়াউর রহমান : সংসদে বিএনপি দলীয় সদস্য হারুনুর রশীদের বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর আসল খুনি জিয়াউর রহমান। মৃত বলে তাকে আসামি করা হয়নি। সেই সময়কার স্বরাষ্ট্র সচিব রেজাউল হায়াত বলেছিলেন, তাকে আসামি করা যাবে না। সে কারণে জিয়ার নামটি দেওয়া হয়নি। যেহেতু মৃত ব্যক্তির বিচার হয় না তাই দিয়ে লাভ নেই। কিন্তু যখন প্রসেডিংস শুরু হয়, সাক্ষী হয় তখন এটা স্পষ্ট জিয়াউর রহমান এ হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এর আগে হারুনুর রশীদ দাবি করেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে জিয়াউর রহমানকে নিয়ে অনুমাননির্ভর বক্তব্য দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে তার নাম আসেনি। তিনি এর ধারেকাছেও ছিলেন না।’

‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগান হিসাবে প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিপরিষদকে ধন্যবাদ দিতে জাতীয় সংসদে তোলা একটি সাধারণ প্রস্তাবের ওপর বক্তৃতা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খানের আনা এ সংক্রান্ত একটি সাধারণ প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পাশ হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংসদে বিএনপির একজন সংসদ সদস্য কী বললেন সেটা দেখলেন। বুঝলেন তাদের মানসিকতা। এরা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। এদের অন্তরে এখনো সেই পেয়ারে পাকিস্তান রয়ে গেছে। পাকিস্তানের গোলামীটাই তারা পছন্দ করেন। বিএনপির হারুন সাহেবের বক্তব্যে এটা প্রকাশ হলো না!

জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর খুনি বলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খুনিকে কেন খুনি বলবে না। আমার কাছে ছবি আছে। ১৯৮৭ সালে খালেদা জিয়া এবং কর্নেল ফারুক কথা বলছেন সেই ছবি আমার কাছে আছে। মাননীয় স্পিকার আপনার কাছে সেই ছবি পাঠিয়েছি। কর্নেল ফারুক আর রশিদের বিবিসির ইন্টারভিউতে আছে জিয়াউর রহমান তাদের সঙ্গে ছিল।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহারের পর আমরা যখন মামলা করতে গেলাম আমি বললাম, জিয়াউর রহমানের নামও থাকতে হবে কারণ সে-ই আসল খুনি। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, তা না হলে খন্দকার মোশতাক তাকে সঙ্গে সঙ্গে সেনাপ্রধান করবে কেন? এগুলো রেকর্ড। কাজেই এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

জয় বাংলা জাতীয় স্লোগানের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উচ্চ আদালতের আদেশে আমরা মন্ত্রিসভায় জয় বাংলা জাতীয় স্লোগানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরে সব জায়গায় এর নির্দেশনা পাঠানো হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের এই প্রস্তাব। এজন্য আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশ এমন একটি পর্যায় চলে যায় যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পরিচয় দিতে সাহস পেত না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। জাতির পিতার হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি দিয়ে বিচারের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। আমাদের বিচার চাওয়ার অধিকার ছিল না। ৭৫-এর পর এমন একটি বাংলাদেশ-মনে হতো এই বাংলাদেশ কী স্বাধীন বাংলাদেশ!

শেখ হাসিনা বলেন, জয় বাংলা স্লোগান-আমার এখনো মনে আছে। যখন জাতির পিতা ৬ দফা দিলেন। এরপর তিনি সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ান। সেই সময় শেখ ফজলুল হক মনিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এই স্লোগানটি ছাত্রলীগের মাধ্যমে মাঠে নিয়ে যাও।

সেই সময় সিদ্ধান্ত দিলেন, আমাদের স্লোগান জয় বাংলা। আমাদের জাতীয় পতাকা কীভাবে হবে-জাতির পিতা নির্দেশ দিয়েছিলেন জাপান উদিত সূর্যের দেশ তাদের পতাকা সাদার মধ্যে লাল। আমাদের সবুজ বাংলাদেশ আমাদের পতাকা হবে সবুজের মাঝে লাল।

এভাবে আমাদের পতাকা হবে। এটাও ছাত্রলীগের মাধ্যমে মাঠে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। পাশাপাশি আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। এটা আমাদের জাতীয় স্লোগানেও বাজানো হয়েছে।

তিনি বলেন, আসল নিউক্লিয়াস ফর্ম করার জন্য ১৯৬১ সালে বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের শেখ ফজলুল হক মনিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেখানে আমির হোসেন আমুসহ অনেক নেতা ছিলেন। কথাগুলো সব সময় তিনি মনি ভাইয়ের মাধ্যমে ছাত্রলীগের কাছে পৌঁছাতেন। আমি নিজে এর সাক্ষী। এটা অনেকের জানার কথা নয় যে, মনি ভাইকে দিয়ে তথ্য উনি পাঠাতেন।

হ্যাঁ যে নামগুলো এসেছে সবাই সক্রিয় ছিল। সিরাজুল আলম খানের যে স্লোগান তার নির্দেশ বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন। স্টেজে বসেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, স্লোগান ধরো। তারপর সিরাজুল আলম খান স্লোগান ধরেছিল-এটা হলো বাস্তব কথা। ইতিহাস বললে সবটুকু বলা দরকার।

জয় বাংলা স্লোগান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেন জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে। এরপর থেকে এই স্লোগান হয়ে যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন এই জয় বাংলার স্লোগানে। এই স্লোগানে ছিল আলাদা একটি উদ্দীপনা। কিন্তু ৭৫-এর পর এ স্লোগান সম্পূর্ণ বন্ধ ও নিষিদ্ধ হয়।

ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের কত নেতাকর্মী এ স্লোগান দিতে গিয়ে জীবন দিয়েছে। এ স্লোগান দিলে নানা ধরনের কথা বলত। অপপ্রচার করত। ঠিক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে যে ব্যঙ্গ করত। ৭৫-এর পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সেই কাজটি করেছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ পদ্মা সেতু চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে : চলতি বছরের শেষ নাগাদ বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের সাহসী পদক্ষেপের অংশ হিসাবে সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু হতে যাচ্ছে। এটা ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং প্রকল্পগুলোর একটি। সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এ তথ্য জানান। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে লিখিত প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু ছাড়াও অনান্য বিষয়ে আনীত প্রশ্নের উত্তর দেন।

সরকারি দলের সদস্য শহীদুজ্জমান সরকারের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের সংশোধিত ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এই প্রকল্পের উভয় প্রান্তে অ্যাপ্রোচ রোড ও সার্ভিস এরিয়ার কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। মূল সেতুর ভৌত অগ্রগতি অগ্রগতি ৯৬ দশমিক ৫০ শতাংশ।

বর্তমানে সেতুতে কার্পেটিং, ভায়াডাক্ট কার্পেটিং, ওয়াটারপ্রুফ মেমব্রেন, মূল সেতু ও ভায়াডাক্টের মুভমেন্ট জয়েন্ট, ল্যাম্পপোস্ট, অ্যালুমিনিয়াম রেলিং, গ্যাসের পাইপলাইন, ৪০০ কেভিএ বিদ্যুৎ এবং রেললাইন নির্মাণকাজ চলছে।

২০২২ সালের শেষ নাগাদ পদ্মা সেতু চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করতে কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে।

নিত্যপণ্যের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে : সরকারি দলের সদস্য কাজিম উদ্দিন আহমেদের প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, করোনা মহামারিতে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে সব দেশেই দ্রব্যমূল্য ভীষণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

এর মধ্যে অনাকাক্সিক্ষতভাবে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর কুফল হিসাবে আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে জনবান্ধব বর্তমান সরকার দেশের নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সম্ভাব্য সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী নিত্যপণের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে জানান, টিসিবির বিক্রয় কার্যক্রম চলমান থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

সরকারের কার্যক্রমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রয়েছে। পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপণ্য সহনীয় পর্যায়ে থাকবে বলে আশা করি। এ সময় তিনি কয়েকটি নিত্যপণ্যের টিসিবি এবং বর্তমান ও পূর্বের বাজার মূল্যের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন।

ষাটোর্ধ্ব নাগরিকদের পেনশন : আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নূর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের বয়স্কগোষ্ঠীকে টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় এনে আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

এ লক্ষ্যে সর্বজনীন পেনশনসংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়ন ও ওই আইনের আওতায় একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

করোনায় বিদেশে গেছে ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৯৫৫ জন কর্মী : আওয়ামী লীগের সদস্য মমতাজ বেগমের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৭৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৯৯ জন কর্মী বিদেশ গেছেন। করোনা মহামারির সময়ে ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৯৫৫ জন কর্মী বৈদেশিক কর্মসংস্থান লাভ করেছেন।

সরকারের সংগ্রহে ২৯ কোটি ৬৪ লাখ ৮৪ হাজার ১২০ করোনার টিকা : সরকারি দলের মোরশেদ আলমের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিনামূল্যে কোভিড টিকা প্রদানের শুরু থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার ২৯ কোটি ৬৪ লাখ ৮৪ হাজার ১২০ ডোজ টিকা সংগ্রহ করেছে।

এ পর্যন্ত ১২ কোটি ৮০ লাখ ৭০ হাজার ৯৪৮ জনকে প্রথম ডোজ এবং ১১ কোটি ৪২ লাখ ৬৭ হাজার ৯৫৬ জনকে দ্বিতীয় ডোজসহ মোট ২৪ কোটি ২৩ লাখ ৩৮ হাজার ৯০৪ জনকে দুই ডোজ ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ১ কোটি ৮১ হাজার ১৯৩ জনকে বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে।

সরকারপ্রধান জানান, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করে বিশ্ববাজারে প্রচলিত দরের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম মূল্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে টিকা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।

আপনার মন্তব্য