ঐতিহাসিক ভাষণ : বাঙালির মুক্তিবার্তা ও বিশ্ব ঐতিহ্যের অমূল্য দলিল

তিতাস মিয়া

 

বাংলাদেশের ইতিহাস আর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের ধুলোবালি মাখা সবুজ ঘাসের ইতিহাস একই সাথে প্রবাহমান। সেই বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল পরবর্তী স্বাধীন বাংলার সূচনা লগ্নেও এটি ছিল মুক্তাঞ্চল। কালের বিবর্তনে রেসকোর্স ময়দানের বর্তমান নাম সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান। বর্তমানে এটি বড় বড় বৃক্ষে-ফুলে শোভিত উদ্যান হলেও একদিন এটি ছিল ধু-ধু মাঠ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে নিজ চোখে দেখা এই মাঠের বর্ণনায় কবি নির্মলেন্দু গুণ (২০১৭) লিখেছেন-
“সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর।
না পার্ক না ফুলের বাগান,-এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখণ্ড অখণ্ড আকাশ যে রকম সে রকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু-ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল
এই ধু-ধু মাঠের সবুজে।”
কখনো কপালে কব্জিতে লাল সালু বেঁধে এ মাঠেই বাংলার ছাত্র-যুবকেরা বিপ্লবী গর্জনে বৃটিশ-পাকিস্তানি শাসকদের বুক কাঁপিয়েছে, কখনো বা এদেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, বৃদ্ধ আর শিশু পাতা-কুড়ানীরা এই মাঠে বাংলার অবিসংবাদিত নেতাদের ফুলের মালায় বরণ করে ঐক্যের বাঁধনে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সুদৃঢ় করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার গৃণ্য ঘোষণা এই মাঠেই দিয়েছিল। ছাত্ররা ‘না-না’ ধ্বনিতে জিন্নাহ্র ঐ ঘোষণার প্রতিবাদ করে এই মাঠেই কার্যত ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেলে তৎকালীন এই রেসকোর্স ময়দানেই ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে এক নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং সেখানেই তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আবার রমনার এই উদ্যানেই এক মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন এবং “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” এই ঘোষণার মাধ্যমে কার্যত দেশের স্বাধীনতাই ঘোষণা করেন।


এখানেই শেষ নয়। দীর্ঘ ৯ মাস বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে এবং রমনার এই মাঠেই(বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যেীথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সৈন্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এই দিনটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিজয় দিবস।


সুতরাং ২৬ মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পূর্বে তাঁর দেয়া ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণার মধ্যদিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরু হয় এই মাঠ থেকে এবং এই যুদ্ধের সমাপ্তিও কার্যত হয় পাকিস্তানি সৈন্যদের এই মাঠে বসে আত্মসমর্পণ দলীলে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়েই। সুতরাং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইতিহাস এবং বাংলাদেশের ইতিহাস একই ভাবে ইতিহাসের পাতায় প্রবাহমান।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উপরিউক্ত মুহূর্তগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের মুহূর্ত। কেননা এই ভাষণটি শুধু এদশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামেই নয়, বিশ্বের ইতিহাসে এই ভাষণটি তাৎপর্যপূর্ণ। ৩০ অক্টোবর ২০১৭ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) এই ঐতিহাসিক ভাষণটিকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা সংস্থাটির ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত করেছে (বিবিসি বাংলা, ২০১৭)।

 


ইতিহাসের পাতায় গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিসের ভাষণ (৪৩১ খ্রিস্টপূর্ব) অত্যন্ত সুপরিচিত যা তিনি স্পার্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধে দেশমাতৃকার মর্যাদা রক্ষার্থে নিহত স্বদেশীয় সৈন্য ও সাধারণ মানুষের স্মরণে প্রদান করেছিলেন। সেই ভাষণ থেকে শুরু করে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগানের ১৯৮৭ সালে বার্লিনে দুই জার্মানির মধ্যকার বিভক্তির দেয়াল (বার্লিন ওয়াল) ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার আহ্বান সংবলিত ভাষণ পর্যন্ত ২৫০০ বছরের বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন সামরিক-বেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ. ফিল্ড, ‘We shall Fight on The Beaches : The Speeches That Inspired History’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ লন্ডন থেকে ২০১৩ সালে প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে অন্যদের মধ্যে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ( মেসিডোনিয়া, প্রাচীন গ্রিস), জুলিয়াস সিজার ( রোম), অলিভার ক্রমওয়েল (ইংল্যান্ড), জর্জ ওয়াশিংটন ( মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (ফ্রান্স), জোসেফ গ্যারিবাল্ডি (ইতালি), আব্রাহাম লিংকন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ভøাদিমির লেনিন (ট.ঝ.ঝ.জ), উড্রো উইলসন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), উইনস্টন চার্চিল (যুক্তরাজ্য), ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), চার্লস দ্য গল (ফ্রান্স), মাও সেতুং (গণচীন), হো চি মিন (ভিয়েতনাম) প্রমুখ নেতার বিখ্যাত ভাষণের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে (হারুন-অর-রশিদ, ২০১৮)। সে থেকেও বুঝা যায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি পৃথীবির ইতিহাসে কত গুরুত্বপূর্ণ!

 


নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ভারতবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দিব’। বঙ্গবন্ধুও বাঙালিদের উদ্দেশ্য করে একই কথা অবচেতন মনে বলেছেন। তিনি উচ্চারণ করেছেন “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষেকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ্”। অনেকেই বলে থাকেন কিশোর বয়সে যেহেতু বঙ্গবন্ধু আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সেই আদর্শিক ব্যক্তিটির কথা মনে পড়ে থাকবে। তাদের ধারণা একেবারে অযৌক্তিক নয় হয়ত। কিন্তু নেতাজির আহ্বানে ক্ষুদিরাম রক্ত দিয়েছেন, মাস্টার্দা সূর্যসেন রক্ত দিয়েছেন, সিপাহী বিদ্রোহে ভারতীয়রা, বাঁশের কেল্লা রক্ষার্থে তিতুমীর ও তাঁর বাহিনীও জীবন দিয়েছেন। কিন্তু সুভাষ বসু (রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা) তত্ত্ব বাস্তবায়ন তিনি করে যেতে পারেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পেরেছেন। ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে তিনি মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে তিনি তাঁর আদর্শিক গুরু নেতাজিকেও হয়ত ছাড়িয়ে গেছেন।
দার্শনিক হেগেল বলেছেন-‘রাষ্ট্র গঠনই সর্বাপেক্ষা মানবিক কর্ম’। বঙ্গবন্ধু এই মহৎ কাজটিই বাঙালির জন্য করেছেন যে মানবিক কাজটি বাংলার ইতিহাসে আর কেউ করতে পারে নি। আমরা সোহরাওয়ার্দীর মত গণতন্ত্রের মানসপুত্র পেয়েছি। এ.কে. ফজলুল হকের মত বাংলার বাঘ পেয়েছি। মাওলানা ভাষাণীর মত মজলুম জননেতাও পেয়েছি এই বাংলায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বাংলার মানুষকে মুক্তি এনে দিয়েছেন। এজন্যই তিনি বাঙালি জাতির পিতা। এজন্যই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তিনি সেই ব্যাক্তি যিনি মাত্র ১৮ মিনিটের এক জাদুকরী ভাষণের মাধ্যমে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সংকল্পবদ্ধ মুক্তি সেনানীতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু আপাদমস্তক একজন বাঙালি ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে ৭ দিন কারা ভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে (দৈনিক প্রথম আলো, ২০১৭)। ১৯৭১ সালে তাকে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দী করে রাখা অবস্থায় কারাগারের প্রকোষ্টেই কবর খুঁড়ে পাকিস্তানের ততকালীন শাসকেরা মৃত্যু থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হিসেবে শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা ঘোষণা প্রত্যাহার করতে বলে। বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাহার না করে বরং বলেছিলেন- ‘আমি বাঙালি, আমি মুসলামান। মুসলমানেরা একবার মরে, দুইবার মরেনা। আমাকে তোমরা মেরে ফেল আপত্তি নেই। তবে আমার মৃত্যুর পরে আমার লাশ আমার বাঙালির কাছে পাঠিয়ে দিও’। এভাবে ফাঁসির মঞ্চেও তিনি চিৎকার করে বলেছেন ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। বাংলা আর বাঙালির প্রতি এই ভালোবাসা আর আত্মার আত্মীয়তা ৭ মার্চের ভাষণের শব্দ চয়নেও ফুটে ওঠে। এই ঐতিহাসিক ভাষণটি তিনি শুরু করেছিলেন বাংলার মানুষকে হৃদয় নিংড়ানো ডাক- ‘ভাইয়েরা আমার’ দিয়ে কেননা বাঙালি তাঁর ভ্রাতৃসম আত্মার আত্মীয়। বাঙালিত্ব তার রক্তের চতুর্থ উপাদান।
৭ মার্চের ভাষণটি লিখিতভাবে স্ক্রিপ্ট দেখে দেখে দেন নি। অথচ অবচেতন মনে প্রদত্ত এই তাৎক্ষণিক ভাষণে সেদিন বিষয়বস্তুর গঠনে কৌশল, শব্দ চয়নে কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, ইতিহাস থেকে নেওয়া শিক্ষা, সময় জ্ঞান ও শব্দচয়নে তাঁর মুন্সিয়ানা অবাক করার মত। বাঙালিকে তিনি ‘আমার দেশের গরিব-দুঃখি-মানুষ’; ‘আমার মানুষ’ বলে উল্লেখ করেছেন। পূর্ববাংলার অধিকার বঞ্চিত এই জেলে মুটে-মজুর, শ্রমিক-কৃষকদের জন্য আজীবন আপোষহীন সংগ্রাম, জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য করে জনতার হৃদয়ের ভেতরে ঢুকে যাওয়া তাঁর মত নেতার পক্ষেই এই ভাষায় শ্রোতাদের সম্বোধন করা সম্ভব। বাংলার মানুষের মুক্তি তাঁর সারা জীবনের দর্শন। তাই হয়ত ভাষণটির মধ্যে ‘মুক্তি’ কথাটি সেদিন তাঁর মুখে বার বার উচ্চারিত হতে দেখি। যেমন- তিনি ভাষণটির চতুর্থ লাইনেই বলেছেন ঃ “আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়’। আবার অষ্টম লাইনে ‘মুক্তি’ শব্দটি এসেছে এভাবে ঃ ‘এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মুক্তি পাবে’। এরপর আবার বলেছেনঃ ‘এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্’। তবে তাঁর সারা জীবনের রাজনৈতিক দর্শন এই ভাষণের যে দুটি লাইনে ছন্দময় হয়ে এসেছে সেটিই উক্ত ভাষণেরও সারকথা। তিনি বলেছেন ঃ “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
নিউজ উইক সাময়িকী বঙ্গবন্ধুকে Poet of Politics’ অর্থাৎ রাজনীতির কবি বলেছেন। কারণ হলো এই বঙ্গবন্ধু মঞ্চে দাঁড়িয়েই নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দার্শনিকসুলভ কথা চারণ কবিদের মতই অবচেতন মনে বলতে থাকতেন। ৭ মার্চের ভাষণে তারই প্রমাণ পাই। উদাহরণ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে ছন্দবদ্ধ করে কবিদের মত বলতে শুনিঃ
“রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব,
এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ……..”
“যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।
…. যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে”।
“তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল,
প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল”।
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
সুতরাং রাজনীতির এই ‘কবি’ অন্তরের আবেগ, প্রয়োজনীয় তথ্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বাংলার মানুষের উপর শত নির্যাতন শোষণের হৃদয়হীন নির্মমতা ও তা থেকে মুক্তি লাভের সম্মোহনী ‘কীওয়ার্ডগুলো’ বারবার ব্যবহার করে কোনো বিদ্রোহী কবির মত মানুষের মনে নতুন ব্যঞ্জনা, বিদ্রোহ আর ইস্পাত কঠিন সংকল্প সৃষ্টি করেছেন। এসব মূল কথাগুলোকে বারংবার ব্যবহার করায় শ্রোতাদের মনে তা স্থায়ীভাবে গেঁথে গেছে। ফলে মানুষ মুক্তির সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এজন্যই তিনি  Poet of Politics’.
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনটি কেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণগুলোর অন্যতম? কেন বিশ্বসম্পদ হিসেবে স্বীকৃত ও গৃহীত?
১ম কারণ হল- যে কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণ মাত্রই প্রচন্ড উদ্দীপনাময়: মুহূর্তে মানুষকে নব চেতনায় জাগিয়ে তোলে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে তাদের প্রস্তুত করতে পারঙ্গম। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে নজিরবিহীনভাবে একত্রিত করে এবং মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। ইতিহাসের যেকোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণ মাত্রই স্বল্পসময়ে সংক্ষিপ্তভাবে দেয়া। যেমন- মার্টিন লুথার কিংয়ের “ I have a dream address”-এর সময় ছিল ১৭ মিনিটি, শব্দসংখ্যা ১৬৬৭। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের সময় ১৮ মিনিট, শব্দ সংখ্যা ১১০৫। বঙ্গবন্ধু হাতে লিখিত কোনো স্ক্রিপ্ট নিয়ে মঞ্চে উঠেন নি। ফলে ভাষণ দেয়ার সময় দেখে দেখে পড়ার জন্য চিরচেনা সেই চশমা চোখে রাখা তাঁর দরকার ছিল না সেদিন । শ্রেষ্ঠ হিসেবে চিহ্নিত ইতিহাসখ্যাত এই ভাষণও হচ্ছে আকারে নাতিদীর্ঘ, হৃদয় উৎসারিত, কালোত্তীর্ণ ও প্রেরণাদায়ী।
৭ মার্চ এক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সবদিক বিবেচনায় রেখে ধীর স্থির অথচ দৃপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু এমনি এক ভাষন রাখলেন, যার নজির ইতিহাসে বিরল। প্রফেসর হারুন-অর-রশিদ (২০১৭) ভাষণের বিভিন্ন দিক গবেষনা করতে গিয়ে বলেন-
ভাষণে একদিকে যেমন ছিলো শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান, অপরদিকে ছিলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের আহ্বান (‘আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি’) গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ (‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব’) মানবিকতা (গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য…) অসাম্প্রদায়িক আদর্শ ও সম্প্রীতি (‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে’)। ভাষনের এসব দিক তথা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দায়িত্ববোধের প্রকাশ ছিল সবার নজর কাড়ার মতো।
১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষনাপত্রে উপনিবেশবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, জাতিগত নিপীড়ন ইত্যাদি থেকে পৃথিবীর সর্বত্র জাতি-জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি গৃহীত ও স্বীকৃত হয়। পাকিস্তানি অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন-শোসন ও জাতি-নিপীড়নের নিগড় থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে নির্দেশিত বঙ্গবন্ধুর অহিংস সংগ্রাম ছিল ঐ নীতি আদর্শের (মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের) সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে সমস্ত দেশের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু সে দিন চারটি দাবী রেখেছিলেন-
১। সামরিক বাহিনীর সমস্ত লোককে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে;
২। যেভাবে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে;
৩। সামরিক আইন (Marshal law) তুলে নিতে হবে;
৪। জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে;
এর পরেও দাবি না মানলে নিরুপায় হয়ে জনগণ কী করবেন তাও তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে বলে দেন- “ আর যদি একটি গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়,…. প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল”।
রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত দেশী-বিদেশি সাংবাদিকসহ উৎসোক জনতার প্রায় সর্বমহলের ধারণা ছিল, বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে সরাসরি বাংলাদেশের একপাক্ষিক স্বাধীনতা যাকে বলা হয় UDI (Unilateral Declaration of Independence) ঘোষণা করবেন। কিন্তু একজন প্রাজ্ঞ, অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্নায়ুযুদ্ধকালীন বিশ্ব রাজনীতির গতিধারা বা মেরুকরণ সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন। তিনি যাতে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বহির্বিশ্বে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে কোনো অবস্থায় চিহ্নিত না হন, সে ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক ছিলেন তিনি। তেমনটি ঘটলে তৎকালীন বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়তো অসম্ভব হয়ে পড়ত। বিশ্ব তখন স্নায়ুযুদ্ধে কম্পমান। তাঁর সামনে জলন্ত দৃষ্টান্ত ছিলো নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন(১৯৬৭-১৯৭০) যা আদর্শিক বিভাজন নির্বিশেষে বৃহৎ শক্তির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে কঠোরভাবে দমন করা হয়। তাই বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ছিলো: পাকিস্তানের (৫৬.৪%) বাঙালি যারা পাকিস্তানের মেজরিটি তারা পশ্চিম পাকিস্তানের (মাইনরিটি) থেকে বিচ্ছিন্ন হবে কেন? বরং মাইনরিটিই আক্রমনকারী, এটাই বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হোক। তাইবঙ্গবন্ধুর৭ মার্চের ভাষণে বিদ্যমান বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাস্তবতায় তিনি কৌশলের আশ্রয় নেন। ভাষণের শেষভাগে তিনি এমনভাবে স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেন, যাতে ঘোষণার কিছু বাকীও না থাকে, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে ‘একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার (UDI) অভিযোগ উত্থাপন করার সুযোগও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী না পান। অর্থাৎ সাপ মরলো, কিন্তু লাঠি ভাঙ্গেনি। বঙ্গবন্ধুর এ কৌশলী অবস্থান তৎকালীন সময়ের অন্যান্য সুদক্ষ সমরকেীশলীদের জন্যও বিস্ময়কর। আমরা আজ এটাও ধরে নিতে পারি যে, বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ কোনোক্রমে (UDI) হিসেবে চিহ্নিত হলে সে অবস্থায় এটি বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত হতো না।
ওয়াশিংটন ডিসির লিংকন মেমোরিয়ালে দাঁড়িয়ে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র যেভাবে “ I have a dreamÓ ” বা একটি ‘স্বপ্নের কথা’ শুনিয়েই তাঁর ভাষণ শেষ করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভূমিকা ছিল আরও অগ্রসর। তিনি ৭ মার্চ এক অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জনতার উত্তাল মহাসমুদ্রে হাজির হন বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বাধীনতার স্বপ্নের বাস্তবায়ন তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামের উদাত্ত আহ্বান নিয়ে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আসন্ন যুদ্ধের বিশেষ করে গেরিলা যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণে বাঙালিদের দিক নির্দেশনা দান শেষে বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ছিল “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।” তিনি জানতেন পরবর্তি আর “হুকুম দেবার” সময় শত্রুপক্ষ তাঁকে নাও দিতে পারে। তাই পরোক্ষভাবে জনতাকে বিশেষভাবে মনে রাখতে বলেছিলেন রক্ত অতীতের মত ‘দরকার হলে আরো দিতে প্রস্তুত থাকতে। কারণ বাঙালির মুক্তির এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম ঐদিন থেকেই শুরু হয়ে গেল’।

  তিতাস মিয়া,

প্রভাষক(রাষ্ট্রবিজ্ঞান), নেত্রকোণা সরকারি কলেজ, নেত্রকোণা