চিত্রেশ মজুমদারের নতুন গল্প ‘এক্সিডেন্ট’

0
8

সৃষ্টিশীল গল্পকার ও প্রাবন্ধিক চিত্রেশ মজুমদারের নতুন গল্প ‘এক্সিডেন্ট’। জনপ্রিয় বাংলা অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ ট্র্যাকারে গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

এক্সিডেন্ট
চিত্রেশ মজুমদার


ভোর চারটাতেই ঘুম ভাঙলো এলার্মে। বাস পাঁচটায়। আমি প্রতি উইকএন্ডেই বাড়ীতে আসি। শনিবার বিকেলে অফিস সেরে বাস ধরি,রবিবার বাড়ীতে থেকে সোমবারে আবার ফিরে যাই। পাঁচটার বাসটা ধরতে পারলে ঠিকভাবে পৌঁছে খেয়েদেয়ে আবার অফিসে রিপোর্ট করতে পারি টাইমে। এভাবেই চলছিলো জীবন,ঠিকভাবেই। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো আজকে।পাঁচটার বাসেই উঠেছিলাম সময়মতো।গন্তব্যে পৌঁছুতে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘন্টা। এই সময়টায় আরামসে একটা ঘুম দিই বাসে বসে,আজকেও দিয়েছিলাম।হঠাৎ খুব জোরে একটা ঝাঁকুনি,প্রচন্ড জোরে সবার চিৎকার,চোখ খুলতে খুলতেই দেখলাম বাস খাদে গড়াচ্ছে।মাথায় খুব জোরে চোট পেলাম হঠাৎ।আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

হঠাৎ চোখ খুললো আবার! ঘড়িতে সময় দেখলাম ভোর ছয়টা।উঠে দাঁড়ালাম কোনওরকম সমস্যা ছাড়াই,বাস থেকেও বেরিয়ে এলাম বিনা বাধায়!আর তখনই বুঝে গেলাম যে যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে!আমি বেরিয়ে এসেছি ঠিকই,কিন্তু আমার দেহটা ওখানেই পড়ে আছে!হায় ঈশ্বর! ব্যাপারটা মানতে না পারলেও মানতে হবে এটা বুঝে গেলাম মুহুর্তের মধ্যেই!কিছু করার নেই!চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম।সবচেয়ে দুঃখের এবং বাজে ব্যাপার কি জানেন?আমিই একমাত্র মানুষ ছিলাম যে মারা গিয়েছি এক্সিডেন্টে!বাকী সবার হাত,পা,মাথা সবই ভেঙেছে কিন্তু প্রাণে মরেনি কেউই! এবার প্রচন্ড বেশী গায়ে লাগলো!এতবড় একটা বাসে মরার জন্য আমিই একমাত্র ছিলাম?কিন্তু এখন এই প্রশ্নটা করবো কাকে? শুনবেই বা কে?

আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যেই বোধহয় আমার সামনের একজন লোক এগিয়ে এলেন!ইনি আবার কে?এরকম অদ্ভুত পোশাক পরা?ওঃ,বুঝলাম!ইনি আর কেউ নন!স্বয়ং যমরাজ!উনি আমার দিকেই এগিয়ে এলেন!আমি সব বুঝে গেলাম।কিন্তু এবার চোখ ফেটে জল এলো।আমি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম কিছু মানুষের কথা মনে হওয়ার পর! আরও সংক্ষেপে বলতে গেলে আমার মনে পড়লো মোট চারজনের কথা,আমার মা,আমার বাবা,বাড়ীর পোষ্য কুকুর বিট্টু, আর অর্ণাবী,আমার গার্লফ্রেন্ড যার সঙ্গে এবছরের শেষেই আমার বিয়ে হওয়ার কথা চলছে!

যমরাজ সবই বুঝতে পারলেন!উনি এগিয়ে এসে খুব আস্তে করে বললেন,”চোখ মুছে নাও,সঙ্গে চলো!তোমার এতটুকুই সময় ছিলো পৃথিবীতে!”

আমি খুব স্মার্ট একজন লোক,অফিসে আমার ডিপার্টমেন্টের হেড আমি।আমি কথা বাড়ালাম না,যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে।নিজের নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম শেষবারের মতো তারপর ওনার সঙ্গে এগিয়ে গেলাম!মরার পরেও যে মানুষের সময় শেষ হয়না সেটা উপলব্ধি করলাম জীবনে(অথবা মরার পরে) প্রথমবার!যমরাজ আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রশ্ন করলেন,

“তোমার কি কোন শেষ ইচ্ছে বা বিশেষ ইচ্ছে ছিলো মনে?”

বেঁচে থাকলে হয়তো অফিসের কথা,ফ্ল্যাট আর গাড়ীর ই এম আই,অডিট,ইনভেস্টমেন্ট এসব নিয়েই বলতাম,যেগুলো নিয়ে ভেবে গিয়েছি সারাক্ষণ।কিন্তু মজার কথা হোলো এখন এসব কিছুই মনে এলোনা, মনে এলো শুধু,ওইযে বললাম চারজন,ওদের কথাই!অবশ্য আমি খুব শান্ত স্বভাবের লোক,যেকোন পরিস্থিতিতেই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারি,তাই আমি খুব শান্তভাবেই ওনাকে উত্তর দিলাম,

“একটা শেষ ইচ্ছে আছে!জানি পূরণ করা সম্ভব নয় তবে কোনওভাবে আমাকে সুযোগ দেওয়া যেতে পারে কি?”

“বলো শুনি কি বলতে চাও!”যমরাজও শান্তভাবেই উত্তর দিলেন!

“আমি আমার মা বাবাকে,আমার হবু স্ত্রীকে ‘ভালোবাসি’ বলে আসতে চাই আর আমার পোষা কুকুরটাকে আদর করতে চাই শেষবারের মতো!দেখুন,এখনও এই এক্সিডেন্টের খবর পৌঁছয়নি আমার বাড়ীতে,আপনি সুযোগ দিলে সময়ের আগেই সেই ইচ্ছেটা পূরণ হতে পারে,দেবেন সুযোগ?”

আমি জানতাম আমার এই ইচ্ছে পূরণ হবেনা কিন্তু যমরাজ যেটা বললেন,সেটা শোনার জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলামনা!

“ঠিকআছে!খুব তাড়াতাড়ি কথা শেষ করেই ফিরে আসবে আমার সঙ্গে!চলো!”

আমার মাথায় তখন আর অন্যকিছু কাজ করছেনা!আমরা মুহুর্তের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমার বাড়ীতে!যমরাজ গেটের বাইরে দাঁড়ানো আর আমি ঘরের সামনে!মাকে ডাক দিলাম জোরে জোরে!
মা দরজা খুলে অবাক হোলো খুব!
“কিরে বাবাই!আবার ফিরে এলি?কি হয়েছে?সব ঠিক আছে?গাড়ী খারাপ হোলো নাকি?ঘরে আয় আগে!”
“আরে মা,এসব কথা পরে হবে,বাবাকে ডাকো আগে!বাইরে আসতে বলো!”
মা বাবাকে ডাকতে গেলো, ততক্ষণে বিট্টু আমার গায়ে উঠে গিয়েছে(কিন্তু আমাকে ধরতে পারছেনা,ওটা সম্ভব নয় ওর পক্ষে, কারোর পক্ষেই না,ও অবাক হয়ে চিৎকার করছে!)
আমি বিট্টুকে বললাম,”বিট্টুসোনা,তোকে খুব ভালোবাসি!ভালো থাকবি,দুস্টুমি কম করবি,মা বাবাকে দেখে রাখবি!”
ও কি বুঝলো জানিনা, তবে ততক্ষণে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে!
এরই মধ্যে বাবা বেরিয়ে এলো!আমি আর সময় নষ্ট করলামনা,সরাসরিই ওদেরকে বললাম,
“মা,বাবা!আমি তোমাদেরকে খুব ভালোবাসি গো, খুব ভালোবাসি!এই যে এতকিছু পরিশ্রম করছিলাম, যা কিছুই করছিলাম সেটা শুধু তোমাদের ভালো রাখার জন্যেই গো!আর তোমাদের সঙ্গে যে এতো ঝগড়া করতাম,সেটা আসলে তোমাদের ভালোবাসি বলেই,আর কিছুনা!আর বাবা শোনো,তুমি ঠিক একঘন্টা পরে আমার অফিসের বস সুজয় স্যারকে ফোন করবে,ওনার সঙ্গে তোমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকবে,ভুল করবেনা,কেমন?এটাই বলার ছিলো!আচ্ছা এবার আসি!”

ওদেরকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ দিলামনা,বা ওদের দিকে আর তাকানোর ক্ষমতা আমার নেই,আমি সরাসরি বেরিয়ে এলাম বাইরে!পরবর্তী গন্তব্য অর্ণাবীর বাড়ী!যমরাজ প্রশ্ন করলেন,

“যা দেখলাম এতক্ষণ,তুমি তো ছেলে ভালোই!মা বাবার সঙ্গে ঝগড়া করতে বললে,কেনো?”

“আরে,সেটা তো আপনিও জানেন!মানে আমাদের মতো ফ্যামিলিতে যা হয় আরকি!আমার বুড়ো মা বাপ!দুজনের চোখেই ছানি!তবুও আমি বাড়ীতে এলে কষ্ট করে রান্না করতে চায়,এটা ওটা করে,আমাকে কাজ করতে দেয়না,সহ্য হয় বলুন?তার উপর সংসারের খরচ যাতে কমে এজন্যে ওরা অনেক কষ্ট করে,অথচ আমি কষ্ট করি ওদের জন্যে যাতে একটু বেশী পয়সা খরচ করে ওদের আরেকটু ভালো রাখতে পারি!কিন্তু ওরা আমার কথা শোনেনা!এজন্যেই যত ঝগড়া!আসলে কি জানেন তো?বেঁচে থাকতে সবই করেছিলাম ঠিকঠাক, দায়িত্বে পালন করতেও ভুল করিনি,কিন্তু শুধু ‘ভালোবাসি’ এই কথাটাই বলা হয়ে ওঠেনি!”

ততক্ষণে কথা বলতে বলতে আমরা পৌঁছে গিয়েছি অর্ণাবীর বাড়ীতে!আস্তে করে ডাক দিলাম ওকে!ও জেগেই ছিলো!আমাকে দেখে অবাক হোলো খুব,
“বাবাই তুই?তুই যাসনি সকালে?”

“নারে,যাচ্ছি এখন!আচ্ছা শোননা,তোকে একটা কথা বলার ছিলো!আসলে তোর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত্য সব তো তুই নিজেই টেনে নিলি সব,আমি তো কিছুই করলামনা, এমনকি তোকে ভালোবাসি কথাটাও মন খুলে বলতে পারলামনারে!আমার আসলে খুব লজ্জা করতো এসব বলতে জানিস তো?ইনফ্যাক্ট কিছুটা ন্যাকামিও মনে হোতো তোর কথাগুলো শুনে!আমি আসলে খুব প্র্যাকটিক্যাল ছিলাম তো,তাই মনেহয়!আচ্ছা বাদ দে এসব,যেটা বলতে এসেছিলাম, আমি আসলে তোকে খুব ভালোবাসি,খুব বেশী, যেরকম তুই আমাকে ভালোবাসিস,আমিও ঠিক ততটাই!তোকে খুব ভালোবাসি,এটা বলতেই এলাম রে!এখন ফিরে যাচ্ছি!তবে আরেকটা কথা, তুই একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করে নিবি,খুব ভালো একটা ছেলে, আমার মতো কোন গবেট না,যে কিনা ভালোবাসি কথাটাও মুখে বলতে খুব বেশী দেরী করে ফেলে!আচ্ছা এখন আসি রে!”

আমি আর একমুহুর্তও ওখানে দাঁড়ালাম না,চলে এলাম!অর্ণার দিকে তাকানোর ক্ষমতাও আমার নেই!জানিনা ও কিভাবে তাকিয়ে আছে, কি ভাবছে!থাক,একটু পরে এমনিতেও সব বুঝে যাবে!

যমরাজ প্রশ্ন করলেন,”খারাপ লাগছে খুব?”

“কি আর বলবো?সবই নিয়তি সেটা আমিও বুঝি!এই মেয়েটা আমাকে খুব ভালোবাসে গো!আমার একটা ছবিও এঁকে দিয়েছিলো এবার,ব্যাগে রয়ে গেছে,ও খুব ভালো ছবি আঁকে!খুবই গুণী মেয়ে ও!আমি ভাগ্যবান ছিলাম যে ওর মতো একটা মেয়ে পেয়েছিলাম জীবনে কিন্তু ভবিষ্যৎটা ঠিকভাবে গুছিয়ে নিতে গিয়েই ওকে আর মনখুলে ভালোবাসি বলা হয়ে ওঠেনি কখনও!”আমি চোখ বন্ধ করলাম!

“আবার সুযোগ পেলে কি করতে?”

“কি আর করতাম?ভালোবাসার মানুষগুলোকে মুখ ফুটে অন্তত ভালোবাসি বলে যেতাম সারাক্ষণ!ভালোবাসি বলেই যে আমরা এতকিছু করি সেটা যেমন ঠিক,কিন্তু তেমনি সময় থাকতে মুখেও যে ভালোবাসি বলতে হয়,কিছু একান্ত সময় কাটাতে হয়,কিছু মুহুর্ত বানিয়ে রাখতে হয় সারাজীবনের জন্যে,ওই জিনিসগুলোই করতাম সবার আগে!বাকী সব এমনিতেই হয়ে যায়,কিন্তু সময় থাকতে থাকতেই ভালোবাসি বলে যেতে হয়,এই কথাটাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যেতাম!”আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম একটা!

“মনে থাকে যেনো” বলে যমরাজ একটা মুচকি হাসি দিলেন,তারপর আমার আর কিছু মনে নেই!

কিছুক্ষণ পর…

মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে!মাথা ফেটে রক্তও বের হচ্ছে দেখলাম!শরীরটা ওঠাতে পারছিনা কোনওভাবেই!ফায়ারসার্ভিসের লোক সামনে দাঁড়িয়ে,ওরাই আস্তে আস্তে করে আমাকে টেনে বের করলো!পা ভেঙে গিয়েছে বুঝতে পারলাম!মাথা ফেটেছে,পা ভেঙেছে!এক সেকেন্ড,এক সেকেন্ড!আমি মরিনি!আমি বেঁচে আছি!হ্যাঁ, আমি বেঁচে আছি!পাগলের মতো চারদিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলাম,”আমি বেঁচে আছি”!আমাকে এম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে আস্তে আস্তে করে!কারোর মুখেই কোন কথা নেই!এম্বুলেন্সের বেডে শোওয়ার আগে মনে হোলো, কে যেনো আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে মিলিয়ে গেলো বাতাসে!

এক্সিডেন্ট
চিত্রেশ মজুমদার বাবাই

(পুনশ্চঃ– সব গল্পের শেষ কিন্তু আমার গল্পের মতো এতো সুন্দর ও পারফেক্ট হয়না!কাজেই সময়ের কথা সময়েই বলে দেবেন,ভবিষ্যতের জন্যে কোনওকিছু পেন্ডিং রাখবেননা!ভালো থাকবেন,ভালোবাসবেন)

আপনার মন্তব্য