রেখে যাই মঙ্গলময় দু’টি হাত

0
4

আমাদের মৃত্যু সে দিনই নিশ্চিত হয়েছে যে দিন জন্মেছি। জীবনের অস্তিত্ব মানে অপেক্ষমাণ মৃ্ত্যুর অস্তিত্ব। জীবনের পরে যে অনন্ত জীবন সে জীবন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মৃত্যুর পর যেমন আর মৃত্যু নেই, তেমনি ভালো মন্দ করার মাধ্যমে সে জীবনের অবস্থা পরিবর্তনেরও সুযোগ নেই। জীবিতকালে পৃথিবী থেকে ভালো মন্দ যা করে যাব তাই সাথে যাবে। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের ‘বুকস্ অব একাউন্টস’ সাজানো ও বাঁধাই হবে জীবিতকালে সম্পাদিত ভালো-মন্দ কর্মের সমন্বয়ে। এটা হবে এক বিশদ ও সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম হিসাবের বই। বাদ পড়বে না ভালো বা মন্দ কোনো কিছুই। ব্যক্তির নিজ উদ্যোগে তাতে নতুন কোনো এন্ট্রি এডিশন বা ডিলিশনের সুযোগ থাকবে না। তবে এ ‘বুকস অব একাউন্টসে’ নতুন পাতা, নতুন এন্ট্রি ও নতুন কলেবর যোগ করার মাধ্যমে আমাদের হিসাবের খাতাকে সমৃদ্ধ অথবা আরো নাজুক করতে পারবে আমাদের পৃথিবীতে ছেড়ে যাওয়া প্রিয়জনের কর্মময় হাতগুলো তাদের ভালো-মন্দ কর্মের মাধ্যমে। তাই, আমাদের চেষ্টা করা উচিত নিজেদের হাতগুলো কল্যাণময় কাজে যুক্ত করে মঙ্গলময় করার মাধ্যমে প্রিয় উত্তরসূরীদের মঙ্গলময় হাত গড়ার শিক্ষা দিয়ে যাওয়া। প্রশ্ন হলো সেটা কীভাবে? আসুন একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

দুই।।
সন্তানদের সাথে নিয়ে আপনি আপনার গত হওয়া মা-বাবার জন্য দোয়া করুন। নিয়মিতই দোয়া করুন। আপনি প্রায়ই আপনার মা-বাবার স্মরণ করুন আর সন্তানদের কাছে তাঁদের প্রতি আপনার কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসার গল্প করুন। দোয়া করুন-
‘রাব্বির হামহুমা কামা রব্বায়ানি ছগিরা’
অর্থাৎ “হে আমার রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’। -সূরা বানি ইসরাঈল : ২৪।
আপনার পিতা-মাতার জন্য আপনার প্রার্থনা আপনার সন্তানদের জন্য শিক্ষা। এ শিক্ষা বহুগুণ বেড়ে আপনার জন্য পরবর্তীতে আশির্বাদ হয়ে ফিরে ফিরে আসবে।

তিন।।
মরহুম পিতা-মাতার জন্য দান-সাদকাহ করুন সাধ্য মতো। কখনো কখনো সন্তানদের সামনে বা তাদের হাত দিয়েই দান-সাদাকাহ করুন। তাদেরকে শিখান উপরের হাত নিচের হাত হতে উত্তম। হাদীসে এসেছে, আয়েশা রা. বলেন- “জনৈক ব্যক্তি রাসুল (সা.) এর কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল আমার মা হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেছেন। তাই কোনো অছিয়ত করতে পারেননি। আমার ধারণা তিনি যদি কথা বলার সুযোগ পেতেন তাহলে দান-সাদাকাহ করতেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে সাদাকাহ করলে তিনি কি এর ছাওয়াব পাবেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই পাবেন।” -সহীহ মুসলিম : হাদিস নং ২৩৭৩। সন্তানদেরকে সাদাকায়ে জারিয়া যা প্রবাহমান ও চলমান ভালো কাজ অর্থাৎ চলমান সাদাকাহ প্রদান করার বিষয়ে শিখান। সাদাকায়ে জারিয়া হলো যার পূণ্য চলমান থাকে।যেমন- পানির কূপ খনন করা, নলকূপ বসানো, দ্বীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, কুরআন শিক্ষার জন্য মক্তব প্রতিষ্ঠা করা, মানব কল্যাণের লক্ষ্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রতিষ্ঠান তৈরি করা ও স্থায়ী জনকল্যাণমূলক কাজ করা। নিজে দান-সাদাকাহ করার মাধ্যমে সন্তানদেরকে এ কাজে অভ্যস্ত ও উদ্বোদ্ধ করুন। তাদের দান-সাদাকার সম্প্রসারিত হাত সমাজের দীনহীনদের জীবনে কিছুটা স্বস্তি আনার পাশাপাশি পরকালে আপনার প্রশান্তির সীমারেখাকে সীমাহীন করবে, ইনশা’আল্লাহ।

চার।।
উত্তম আচরণের অভ্যাস করুন। সন্তান শিখবে আপনার থেকে। সন্তানের উত্তম আচরণ ও উন্নত স্বভাবের পূণ্যফলের আপনিও অংশীদার হবেন। সন্তানকে উত্তম আচরণ ও নৈতিকতার শিক্ষা দিন। উত্তম শিক্ষাদান সাদাকায়ে জারিয়া সম। উত্তম শিক্ষা আর উত্তম আচরণের দীক্ষায় পুষ্ট আপনার সন্তানের দু’হাত আপনার কল্যাণ কামনায় খোদার রাহে উঠবেই।

পাঁচ।।
আপনি আপনার মরহুম মা-বাবার বন্ধুদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, সম্মান করা, তাঁদেরকে দেখতে যাওয়া ও তাঁদেরকে হাদিয়া দেয়ার চর্চা করুন। এ বিষয়ে হাদীসে উল্লেখ আছে, “পুত্রের জন্য পিতার বন্ধু-বান্ধবের সাথে ভালো ব্যবহার করা সবচেয়ে বড় কাজ? সওয়াবের কাজ।”-সহীহ মুসলিম : হাদিস নং ৬৬৭৭।
আপনার মা-বাবার বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-সজনদের সাথে উষ্ণ ব্যবহারের এ সুঅভ্যাস আপনার সন্তানাদিতে স্থানান্তরিত হবে যা আখেরে আপনার কল্যাণেরই কারণ হবে।

ছয়।।
আপনার সন্তানকে বিনয়ের শিক্ষা দিন। ভালো কাজের শিক্ষা দিন। হাদীসে এসেছে, ‘ভালো কাজের পথপ্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে’। -সুনান আত তিরমীযি : হাদিস নং ২৬৭০।
ভালো কাজের ব্যবহারিক শিক্ষা পাওয়া সন্তান আপনার জন্য ভালো কিছুই হাদিয়া হিসাবে আপনার আত্মার শান্তির লক্ষ্যে প্রেরণ করতে সপ্রণোদিত থাকবে এটাই স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশিত।

সাত।।
আপনি আপনার সন্তানদের সাথে নিয়ে আপনার মা-বাবার কবর জিয়ারত করুন। এটা তাদেরকে ধর্মভীরু হতে সাহায্য করবে। আপনার মৃত্যুর পর তাদের হাতগুলো মঙ্গলময় হয়ে উঠবে আপনার জন্য। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমরা কবর জিয়রাত কর, কেননা তা আখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়।” -সুনান তিরমীযি : হাদিস নং ১০৫৪।
আপনার পিতা-মাতার কবর জিয়ারতের এ পূণ্যচর্চার ধারাবাহিকতা আপনার ক্ষেত্রেও আপনার সন্তান অভ্যাসবশত হলেও ধারাবাহিক রাখবে যা আপনার জন্য পরম প্রশান্তি আর আনন্দের কারণ হবে বৈ কি।

শেষ।।
পৃথিবীতে উত্তম গুণশুন্য সন্তান হলো সবচেয়ে গরিব সন্তান। পৃথিবীতে এমন অনেক দীনহীন গরিব আছে যাদের টাকা ছাড়া আর কিছুই নেই। সন্তানদেরকে জ্ঞান, পূণ্যকর্মের চর্চা, সদাচারণ, দয়া, পর মত ও পর ধর্মের প্রতি সহনশীলতার শিক্ষা এবং মানবতার শিক্ষার অমূল্য সম্পদ আমাদের দিয়ে যাওয়া উচিত। তবেই তাদের হাতগুলো আমাদের ইহকাল ও পরকালের জন্য হয়ে উঠবে মঙ্গলময়।
পুনশ্চ: এ লেখার মুখ্য উদ্যেশ্য আমার নিজেকে সংশোধন করা। আমার নিজের অক্ষমতা, অপারগতা আর নিজের অনভ্যাস সম্পর্কে নিজেকে সচেতন করা।

লেখক: মাহবুবুর রহমান
ডেপুটি কমিশনার অব ট্যাক্সেস

আপনার মন্তব্য